অর্গানিক বা জৈব চাষাবাদ কি? অর্গানিক বা জৈব চাষাবাদে কি কি ব্যবহার করলে বেশি লাভবান কম খরচে হওয়া যায়?
অর্গানিক বা জৈব চাষাবাদে কি ভাবে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং জৈব বালাইনাশকপ ব্যবহার করা
১. জৈব বা অর্গানিক চাষাবাদ কি ?
জৈব চাষাবাদের ধারণার উৎপত্তি আসলে আদিম। সুপ্রাচীন কাল থেকে এ পদ্ধতিতেই অর্থাৎ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেই চাষাবাদ হয়ে আসছে। রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশক, গ্রোথ হরমোনসহ যে কোন রাসায়নিক পদ্ধতি ছাড়া জৈব সার যেমন, কম্পোস্ট সার, আবর্জনা সার, জৈবিক নাইট্রোজেন সংযোগকারী বা বিএনএফ উদ্ভিদ ও জৈব উৎস হতে পাওয়া অন্যান্য বর্জ্য পদার্থসমূহ, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা, গোবর, পশুর শুকনো রক্ত, হাড়ের গুঁড়া, সবুজ সার, অ্যাজোলা, ছাই। বর্তমান সময়ে কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং জৈব কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যাবস্থাপনায় পরিবেশবান্ধব উপায়ে ফসল উৎপাদন করার নামই হচ্ছে অর্গানিক ফার্মিং।
২. কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং জৈব বালাইনাশক ব্যাবহার কেন?
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, আগের দিনে বৃষ্টি হলেই প্রচুর কেঁচো এবং অন্যান্য কিট পতঙ্গ মাটি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখা যেত, তবে আজকাল মাটি কুপিয়ে খুজে খুজেও কেঁচো এবং ঐ সমস্ত কীট পতঙ্গের দেখা মেলে না। মনে কি প্রশ্ন জাগেনা, কেঁচো এবং ঐ সমস্ত কিট পতঙ্গগুলো গেলো কোথায় ? হ্যাঁ, আমরাই তাদেরকে হত্যা করেছি । রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারে বিনষ্ট হয়েছে জীব বৈচিত্র, বিলুপ্ত হয়েছে বহু পশু পাখি, জলের বহু সুস্বাদু মাছ, মারা গেছে মাটির উপকারী অণুজীব, উপকারী কীট পতঙ্গ ও অত্যান্ত মুল্যবান কেঁচো। অনেকের কাছেই কেঁচো দেখলে ঘেন্না লাগলেও এরাই কিন্তু ধরে রাখতো মাটির সুস্বাস্থ্য এবং ফসল উৎপাদনে পালন করতো পরম বন্ধুর ভুমিকা। যেহেতু এখন আর এসব কীট পতঙ্গ ও কেঁচো মাটিতে নেই বললেই চলে সেহেতু মাটিতেও নেই মাটির প্রয়োজনীয় নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান সমূহ। আর তাই মাটির শক্তি পুনরায় ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে রাসায়নিক চাষাবাদ বন্ধ করতে হবে এবং জৈব চাষাবাদ তথা কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং জৈব বালাইনাশক ব্যাবহার বাড়াতে হবে।
৩. কেঁচো বা ভার্মি কম্পোস্ট কি এবং কেন ?
জমির উর্বরতা বাড়াতেই মূলত কেঁচো কম্পোস্ট সার ব্যবহার করা হয়। এটি একটি জৈব সার। কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির আগে দরকার হয় কেঁচো। কেঁচোরাই মূলত এই সার তৈরির আসল কারিগর। আধা শুকনো গোবর, লতাপাতা, গাছের পাতা, খড়, পচনশীল আবর্জনা ইত্যাদি খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে এবং এর সাথে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরি হয় ।
বিজ্ঞানী চালর্স ডারউইন সর্বপ্রথম কেঁচোর গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সবাইকে অবগত করেন। তিনি বলেন, কেঁচো ভূমির অন্ত্র এবং পৃথিবীর বুকে উর্বর মাটি তৈরি করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে, যার ওপর আমরা ফসল উৎপাদন করি। এ অতি সাধারণ, ক্ষুদ্র প্রাণীটি পচনশীল জৈবপদার্থ থেকে সোনা ফলাতে পারে, কেঁচোসার বা ভার্মিকম্পোস্টে রূপান্তরিত করে। আহার পর্বের পর যে পাচ্য পদার্থ মলরূপে নির্গমন হয় তাকে কাস্ট বলে। এ কাস্টের ভেতর জীবাণু সংখ্যা এবং তার কার্যকলাপ বাড়ার কারণে মাটির উর্বরতা বাড়ে। দেখা গেছে, পারিপার্শ্বিক মাটির তুলনায় কাস্টের মধ্যে জীবাণু সংখ্যা প্রায় হাজার গুণ বেশি। এ কাস্টের ওপরে বিভিন্ন প্রকার উৎসেচক উৎপাদনকারী ব্যাক্টেরিয়া জীবাণু বেশি থাকায় মাটির উর্বরতাও বাড়ে। কাস্টের কারণে মাটি থেকে গাছে ৬ শতাংশ নাইট্রোজেন এবং ১৫-৩০ শতাংশ ফসফরাস যোগ হতে দেখা গেছে। এছাড়াও অন্যান্য উদ্ভিদ খাদ্য উপাদান ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম গাছ বেশি পরিমাণে গ্রহণ করতে পারে। কেঁচোর উপস্থিতিতে জৈবপদার্থের কার্বন ও নাইট্রোজেন অনুপাত প্রায় ২০.১ এর কাছাকাছি হয়। এ অনুপাতে গাছ সহজেই কম্পোস্ট থেকে খাদ্য গ্রহণ করতে পারে।
৪.জৈব বালাইনাশক কি এবং কেন ?
জৈব বালাই ব্যবস্থাপনার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে বিভিন্ন পোকামাকড় ও রোগ দমনের জন্য সমন্বিত বালাই দমনব্যবস্থা। পোকামাকড় ও রোগবালাই থেকে ফসলকে রক্ষার জন্য চাষিরা জেনে বা না জেনে যত্রতত্র কীটনাশক ব্যবহার করেন। এর ফলে পোকার মধ্যে কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে উঠেছে, যে কারনে বারবার কীটনাশক ব্যবহার করেও পোকা দমন হচ্ছে না। এভাবে অপরিকল্পিত কৌশল ও মাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং মানব স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। কীটনাশকের বিষাক্ততার জন্য চাষির স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে এবং যারা এসব কীটনাশক প্রয়োগকৃত সবজি খাচ্ছেন তাদের দেহের মধ্যে কীটনাশকের বিষক্রিয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুকি দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে অপরিকল্পিত কীটনাশক ব্যবহার করার দরুন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে সবজি রপ্তানি করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জৈব কৃষিতে ফসল সংরক্ষণ ও বালাইনাশক হিসেবে কিছু কিছু গাছের পাতা, ডাল, মূল বা বাকলের রস ভেজষ কীটনাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের কিছু ভেষজ গাছপালা হলো ধুতরা, ভেন্নার তেল, রেড়ি, বন্যতামাক, পেঁপে, শিয়ালমুথা, আফ্রিকান ধৈঞ্চা, বিশকাটালি, নিম, নিশিন্দা, অড়হর, তুলসীপাতা, ডোলকলমি, টমেটো-গাছপাতা, ল্যান্টানা, মেক্সিকানগাঁদা, পাটের বীজ, নিম, মেহগনি এসব।
৫. কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট সার কোথায় ব্যবহার করবেন ?
সকল প্রকারের শাক সবজি ক্ষেতে ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে শাক সবজির ফলন বাড়ানো যায়। ধান, গম, পাটসহ বিভিন্ন ফলবাগানে এই সার ব্যবহার করে ভাল ফলন পাওয়া যায়। এই সার ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ে মাটিতে বায়ুচলাচল বৃদ্ধি পায়। মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়ে, মাটির বিষাক্ততা দূরীভূত হয়। মাটির অনুজৈবিক কার্যাবলী বৃদ্ধি পায় ফলে মাটি হতে গাছপালার পুষ্টি পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে যায়। ধানের জমিতে বিঘাপ্রতি ৫০ কেজি ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার করে অর্ধেক ফলন পাওয়া যায়। এই সার পুকুরে ব্যবহার করে ফাইটোপ্লাংকটন উৎপাদন ত্বরান্বিত করে মাছের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
এই ভাবে অর্গানিক চাষাবাদে কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট এবং জৈব বালাইনাশকপ ব্যবহার করে বেশী লাভবান হওয়া যায়