সুস্থ থাকতে ‘জে কে লাইফস্টাইল’: জীবনযাপনের ৫টি মূলমন্ত্রে নতুন স্বাস্থ্যবিপ্লব!
আধুনিক জীবনে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা অর্জনের জন্য ‘জে কে লাইফস্টাইল’ (JK Lifestyle) নিয়ে এসেছে এক সুনির্দিষ্ট নীতিমালা, যা প্রাচীন সভ্যতা ও জীবনাচার থেকে অনুপ্রাণিত এবং বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ । এই জীবনযাপন পদ্ধতি মূলত ৫টি বিশেষ শর্তের সমন্বয়ে গঠিত, যা সম্মিলিতভাবে পালন করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ।
সুস্থতার ৫টি বিশেষ শর্ত (JK Lifestyle Guideline)
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ২. না খাওয়ার অভ্যাস (অটোফেজি) ৩. ঘুমের অভ্যাস ৪. দৈন্দদিন ব্যায়ামের অভ্যাস ৫. মানসিক প্রশান্তির চর্চা
১. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: কি খাবেন, কি বাদ দেবেন? 🍎🥩
সুস্থতার মূলমন্ত্রে খাদ্যাভ্যাসকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ।
❌ যা যা খেতে পারবেন না (আজীবনের জন্য নিষেধ):
-
সকল ধরনের শস্য জাতীয় খাবার (যেমন: ভাত, রুটি, চিড়া, মুড়ি, নুডুলস, পাস্তা, ওটস, কেক, পিঠা) ।
-
চিনি, গুড়, মধু, সকল কোমল পানীয়, ডায়েট ড্রিংকস, ও জুস ।
-
সরাসরি দুধ, মিষ্টি দই, টক দই, পুডিং ও সকল রকম মিষ্টি ।
-
সকল ধরনের ডাল (যেমন: মসুর, মুগ, ছোলা) ।
-
সয়াবিন, সূর্যমুখী, ভূট্টা, রাইস ব্রান ও অন্যান্য সকল ভেজিটেবল তেল ।
-
সব ধরনের ফাস্ট ফুড, প্রসেসড ফুড বা বাজারে তৈরী খাবার ।
-
আপাতত নিষেধ: সকল দেশি ও বিদেশী ফল, এবং সবজির মধ্যে আলু, স্কোয়াশ, বেবী কর্ন, কচুর মুখী ।
✅ যে সকল খাবার খেতে পারবেন:
-
তেল (Fat): Organic Extra Virgin Olive Oil, Organic Extra Virgin Cold Pressed Coconut Oil, খাঁটি ঘি, খাঁটি মাখন/Butter, ও ঘানিতে ভাঙ্গানো খাঁটি সরিষার তেল ।
-
প্রোটিন (Protein): কুসুমসহ ডিম, চর্বিযুক্ত/সামুদ্রিক মাছ, তাজা মাশরুম, পরিমিত মাত্রায় দেশি গরু ও খাসীর চর্বিযুক্ত মাংস, এবং দেশি মুরগি ।
-
শর্করা (শাক-সবজি): সকল শাক (যেমন: পালং, পুই, লাল শাক), প্রায় সব ধরনের সবজি (যেমন: ফুলকপি, বাঁধাকপি, ব্রকলি, টমেটো, অল্প গাজর, সবুজ মিষ্টিকুমড়া) ।
-
রান্নার নিয়ম: শাক সবজি অবশ্যই Organic Extra Virgin Olive Oil দিয়ে রান্না করতে হবে । অতিরিক্ত সিদ্ধ করা যাবে না ।
-
-
অন্যান্য: সালাদ হিসেবে শসা, টমেটো, গাজর, লেটুস পাতা, কাঁচা পেঁপে । কাঠবাদাম (১২-২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে খোসা ছাড়িয়ে), কাজু ও চীনা বাদাম (ঘি বা এক্সট্রা ভার্জিন কোল্ড প্রেসড কোকোনাট ওয়েল দিয়ে ভেঁজে) ।
-
পানীয়:
-
Organic Coconut Vinegar/Apple Cider Vinegar With The Mother (১ চামচ ১ গ্লাস পানিতে মিশিয়ে খালি পেটে) ।
-
পর্যাপ্ত পানি (পাঁচ দিন পর থেকে সামান্য Himalayan Pink Salt মিশিয়ে) ।
-
প্রতিদিন ১টি কচি ডাবের পানি ।
-
চিয়া সীড (খাবারের আগে বা পরে) ।
-
হলুদের চা (খাবার খাওয়ার এক ঘণ্টা আগে) ।
-
খাবারের প্লেটে যা থাকবে:
ভিনেগারের পানীয় > শাক-সবজি + ডিম/মাছ/মাংস + সালাদ + বাদাম > চিয়া সীডের পানীয় > ডাবের পানি । খাবার ভালো করে চিবিয়ে সময় নিয়ে খেতে হবে ।
খাবারের অভ্যাস:
জে কে লাইফস্টাইলে ফ্যাট এডাপ্ট্যাশন (Fat Adaptation) পর্বের পর ফুল/ড্রাই ফাস্টিং, ওয়াটার ফাস্টিং, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং, ও ওয়ান মিল এ ডে (One Meal a Day) অভ্যাসের কথা বলা হয়েছে ।
ফ্যাট এডাপ্ট্যাশন (Fat Adaptation): প্রথম ৫-৭ দিন শরীরের মেটাবলিজমকে কার্বোহাইড্রেট থেকে ফ্যাটে শক্তি উৎপাদনের দিকে পরিবর্তন করতে হয় । এই সময়ে যখনই পুরোপুরি ক্ষুধা লাগবে, তখনই উল্লেখিত খাবার পেট ভরে খেতে হবে (২/৩/৪ বার) ।
২. না খাওয়ার অভ্যাস (অটোফেজি): রোগের প্রতিরোধক ⏳
খাবারের পর যে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো উপবাস বা অটোফেজি প্রক্রিয়া ।
-
অটোফেজি (Autophagy): এটি একটি গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘আত্মভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা’ । এটি শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে কোষীয় পর্যায়ে পরিষ্কার করার একটি প্রক্রিয়া, যা কোষের কোনো ক্ষতি না করে বরং কোষকে সজীব রাখতে সাহায্য করে ।
-
উপকারিতা: এটি ক্ষতিকারক প্রোটিনকে ধ্বংস করে , শরীরকে কার্যকরী রাখে, দুর্বল অঙ্গাণু থেকে মুক্তি দেয়, ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করে , রোগ প্রতিরোধ করে এবং যৌবন ধরে রাখতে সহায়তা করে ।
-
চালু করার উপায়: দীর্ঘক্ষণ উপবাসে থাকা বা রোজা রাখা (সবচেয়ে সহজ উপায়) , কম ক্যালরির খাদ্য খাওয়া, শারীরিক পরিশ্রম করা, ও নিয়মিত সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ঘুমানো । খাবারের সংকট তৈরি হলে অপ্রয়োজনীয় ও অপরিপক্ক কোষগুলোকে শরীর খেয়ে নেয়, যার মাধ্যমে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায় ।
৩. ঘুমের অভ্যাস: সুস্থতার চাবিকাঠি 😴
অটোফেজি চালু করার জন্য নিয়মিত সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ঘুমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ।
-
সঠিক সময়: রাত ১০ টার মধ্যেই ঘুমানোর সঠিক সময় শুরু হয়, কারণ রাত ১০টা থেকে ২টার মধ্যে মেলাটনিন হরমোনের মাত্রা বেশি থাকে ।
-
যা করবেন: সঠিক সময়ে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন । আরামদায়ক বিছানা ও শোবার ঘর, নিয়মিত এক্সারসাইজ (সকালে), রাত ৮টা বা ৯টার পর সব ইলেকট্রনিক ডিভাইস বন্ধ রাখা, প্রয়োজনে রাত ৯টার দিকে গরম পানিতে গোসল করা (চুল শুকিয়ে) ।
-
যা করবেন না: দুপুরের পর চা বা কফি পান করা, অ্যালকোহল পান করা, বেশি রাতে ভারী খাবার খাওয়া (নৈশভোজ সন্ধ্যার দিকে সারতে হবে), দিনের বেলা ঘুমানো ।
৪. দৈনন্দিন ব্যায়ামের অভ্যাস: পেশী ও রক্ত সঞ্চালন 💪
দৈনন্দিন ব্যায়ামের অভ্যাস জে কে লাইফস্টাইল এর অন্যতম শর্ত ।
-
প্রাথমিক অভ্যাস: প্রতিদিন সকালের নরম রোদে অন্তত ৪৫ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা হাঁটার অভ্যাস করুন । যদি সম্ভব না হয়, সকালে ও বিকেলে ৩০ মিনিট করে মোট ১ ঘণ্টা হাঁটতে পারেন ।
-
অন্যান্য: বাসায় বসে নানান রকম সহজ ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম ও ইয়োগা ।
-
উপকারিতা: নিয়মিত ব্যায়ামে পেশী শক্তিশালী হয় এবং রক্ত সঞ্চালনসহ নার্ভের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ।
৫. মানসিক প্রশান্তির চর্চা: মন ও শরীরের যত্ন 🧘
শরীর ও মন একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাই শরীরের যত্নের সাথে সাথে মনের যত্ন নেওয়াও জরুরি ।
-
চর্চার উপায়: উপরে বর্ণিত প্রতিটি শর্ত গুরুত্বসহকারে মানা, ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাস করা, ও সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা । ধৈর্য্য ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বাস নিয়ে চলতে হবে ।
রোগীর জন্য বিশেষ নির্দেশনা
-
সাধারণ রোগী (অতিরিক্ত ওজন, ফ্যাটি লিভার, মাইগ্রেন, উচ্চ রক্তচাপ, বাতরোগ ইত্যাদি):
-
১ম সপ্তাহ: ফ্যাট এডাপ্ট্যাশন ।
-
২য় সপ্তাহ: ড্রাই ফাস্টিং/রোজা ।
-
৩য় সপ্তাহ থেকে: ড্রাই ফাস্টিং, ওয়াটার ফাস্টিং ও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সমন্বয়ে রুটিন ।
-
-
ডায়বেটিস রোগী (টাইপ ২):
-
অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের ফলে সৃষ্ট Insulin Resistance-এর কারণে হওয়া এই রোগটিকে জে কে লাইফস্টাইল পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করে ঔষধ ছাড়া পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এমনকি নির্মূল করাও সম্ভব ।
-
ঔষধ ও ইনসুলিন বন্ধ করে শুরু করতে হবে ।
-
১ম সপ্তাহ: ফ্যাট এডাপ্ট্যাশন (৪-৬ বেলার অভ্যাস কমাতে) ।
-
২য় সপ্তাহ: ড্রাই ফাস্টিং বা রোজা ।
-
পরবর্তীতে: ড্রাই ফাস্টিং, ওয়াটার ফাস্টিং ও ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সমন্বয়ে রুটিন ।
-
বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রথম দুই সপ্তাহ প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ও খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে ডায়বেটিস মেপে চার্ট করে লিখে রাখতে হবে ।
-
জেকে লাইফ স্টাইফ দিয়ে কি ডায়বেটিস মুক্ত হওয়া যায়?
হ্যাঁ, জে কে লাইফস্টাইল (JK Lifestyle) টাইপ-২ ডায়বেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে ঔষধ ছাড়া পুরোপুরিভাবে রোগটি নিয়ন্ত্রণ করা বা এমনকি নির্মূল করাও সম্ভব বলে দাবি করে ।
এই লাইফস্টাইল অনুযায়ী, টাইপ-২ ডায়বেটিসে শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ইনসুলিন তৈরি হয় এবং তা দীর্ঘ সময় রক্তে উপস্থিত থাকে । প্রচলিত চিকিৎসায় রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ঔষধ বা ইনসুলিন দেওয়ায় রোগীর শরীরে হাইপার ইনসুলিনিমিয়া (মাত্রাতিরিক্ত ইনসুলিনের উপস্থিতি) সৃষ্টি হয় । এর প্রভাবে রোগীর ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
জে কে লাইফস্টাইল টাইপ-২ ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে পদ্ধতি অনুসরণ করতে বলে, তা হলো:
-
স্বল্প শর্করা, পরিমিত উন্নত প্রোটিন ও স্বাস্থ্যকর চর্বিযুক্ত খাবার: রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য জে কে লাইফস্টাইল নির্ধারিত খাবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । তাই প্রচলিত ঔষধ বা ইনসুলিন বাদ দিয়ে এটি শুরু করতে হবে ।
-
পরিকল্পনা:
-
১ম সপ্তাহ: ফ্যাট এডাপ্ট্যাশন । এই সময় বারবার ক্ষুধা লাগলে জে কে লাইফস্টাইলের নির্ধারিত খাবার পেট ভরে খেতে হবে । ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে না এলে এই পর্ব দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে ।
-
২য় সপ্তাহ: ড্রাই ফাস্টিং বা রোজা রাখতে হবে ।
-
পরবর্তী সপ্তাহ: ড্রাই ফাস্টিং, ওয়াটার ফাস্টিং এবং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সমন্বয়ে খাবারের রুটিন করতে হবে ।
-
-
বিশেষ সতর্কতা: যেহেতু ডায়বেটিসের সকল ঔষধ ও ইনসুলিন বন্ধ করে এই লাইফস্টাইল শুরু করা হবে, তাই প্রথম দুই সপ্তাহ প্রতিদিন সকালে খালি পেটে একবার এবং খাবার খাওয়ার ২ ঘণ্টা পরে আরেকবার ডায়বেটিস মেপে চার্ট করে লিখে রাখতে হবে ।
-
অটোফেজি, ব্যায়াম, ঘুম ও মানসিক প্রশান্তি: খাবারের পাশাপাশি ব্যায়াম, ঘুম ও মানসিক শান্তির চর্চা অবশ্যই চালিয়ে যেতে হবে ।
চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স থেকে মুক্তি পাওয়া এবং পরিমিত মাত্রায় ভাত, ফল, খেজুর, মধু খেয়েও ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা ।


