বীমা কি? কেন সকলের বীমা করা প্রয়োজন?
বিমা করার প্রয়োজনতা একাধিক হতে পারে। কিছু প্রধান কারণগুলো নিম্নরূপ
সুরক্ষা ও নিরাপত্তা
বিমার মাধ্যমে আপনি আপনার অর্থ, সম্পদ, জীবন এবং অন্যান্য মানুষদের উপর নিরাপত্তা সৃষ্টি করতে পারেন। যখন কোনো অপ্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটে বা অন্য কোনো জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা সম্মুখীন হয়, বিমা আপনাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এবং অপ্রাকৃতিক ঘটনা বা ক্ষতির জন্য প্রদান করা টাকা পূর্বব করে।
১. বিমা কী ?
বিমা হলো একটি চুক্তি। বিমা হলো একটি আর্থিক সুরক্ষা ব্যবস্থা যা কোনো অপ্রাকৃতিক ঘটনা, জীবনের অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ঘটনা বা আর্থিক ক্ষতির জন্য সামরিক সহায়তা প্রদান করে। বিমায় সম্পদ, জীবন, স্বাস্থ্য, গাড়ী, বাইক, ব্যবসায়, ভ্রমণ এবং অন্যান্য বিষয়ে বিমার বিভিন্ন ধরণের বিমার উপস্থাপন করা হয়। ইহা দুই পক্ষের মধ্যে একটি আইন সম্মত চুক্তি। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ক্ষতিপূরণ দিবে বলে নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। অন্যপক্ষ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট হারে প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা দিয়ে চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। প্রথম পক্ষ বিমাকারী এবং দ্বিতীয় পক্ষ বিমাগ্রহীতার মধ্যে যথাক্রমে ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং প্রিমিয়াম প্রদানের নিশ্চয়তা সম্বলিত একটি চুক্তি। জীবন বিমার ক্ষেত্রে ক্ষতি পূরণ হয় না, মানুষের জীবনের কোন মূল্য পরিমাণ করা যায় না। তাই জীবন বিমার ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তা প্রদান করা হয়ে থাকে।
যেকোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমা শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিমা জনসাধারণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রিমিয়াম সংগ্রহ করে মূলধন গঠনে সাহায্যে করে। মানুষের জীবন, ঋণ ও সম্পত্তির ক্ষতিপূরণের নিশ্চয়তা দিয়ে থাকে। এরূপ নিশ্চয়তা পাওয়ার ফলে লোকজন তাদের কার্যক্ষেত্রে নিরাপত্তা অনুভব করে এবং কার্যে মনোনিবেশ করতে পারে। ফলশ্রুতিতে, ব্যক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। এভাবে ব্যক্তি উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নত হয় এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ঘটে। উদাহরণ জীবন বিমা চুক্তি,অগ্নি বীমা চুক্তি।
২. বিমা করলে কী কী সুবিধা পেতে পারি ?
(১) জীবনের ও সম্পদের নিরাপত্তা দেয়।
(২) মূলধন সৃষ্টি করে।
(৩) বৃদ্ধ বয়সের এবং আপদকালীন সম্বল।
(৪) মানসিক প্রশান্তি দেয়।
(৫) ব্যবসায়ে অর্থ যোগান দেয়।
(৬) মুদ্রা স্ফীতি হ্রাস করে।
(৭) সামাজিক সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধান করে।
৩. বিমা করার ধাপ সমূহ কী কী?
বিমা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধি অথবা ওয়েব সাইট হতে গ্রাহকের বিভিন্ন পরিকল্প সম্পর্কে অবহিত হওয়া এবং বিভিন্ন পরিকল্প পর্যালোচনা করত পছন্দ মত পরিকল্প নিবার্চন করা। বিমা গ্রাহকের পছন্দমত পরিকল্প গ্রহণের নিমিত্ত বিমা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করা। বিমাগ্রাহকের আবেদন ও দাখিলকৃত আনুসাংগিক কাগজপত্র পর্যালোচনা করত বিমাকারী প্রতিষ্ঠানের অবলিখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। বিমা প্রতিষ্ঠানের সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির পর বিমা গ্রাহক কর্তৃক প্রিমিয়াম পরিশোধ করা।
বিমা গ্রাহক কর্তৃক প্রিমিয়াম পরিশোধের পর বিমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এফ.পি.আর এর মাধ্যমে বিমা চুক্তি চূড়ান্তভাবে সম্পাদন করা। বিমা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক এফ.পি.আর সম্পাদন গ্রাহক কর্তৃক বিমা দলিল সংগ্রহ করা।
৪. প্রিমিয়াম বা বিমার কিস্তি কি ?
বিমা চুক্তিতে বিমাকারী বিমা গ্রহীতাকে ক্ষতিপূরণ বা দাবী পরিশোধের প্রতিশ্রুতির প্রতিদানই হচ্ছে বিমা প্রিমিয়াম। জীবন বিমার ক্ষেত্রে বীমাগ্রহীতা বীমাকারী বা বীমা কোম্পানীকে প্রিমিয়াম প্রদানের ফলেই বিমাসংস্থা নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্তিতে বা মেয়াদ পূর্তির আগেই বিমাকৃত ব্যক্তির মৃত্যু হলে বিমা দাবী পরিশোধ করে থাকে। বিশেষজ্ঞগণের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণে প্রিমিয়ামের সংজ্ঞা নিম্নরূপ
বিমাচুক্তি বলে বিমাকারী বিমা গ্রহীতার নিজের বা অন্যের জীবন অথবা সম্পত্তির উপরে ভবিষ্যতে সম্ভাব্য কোন অনিশ্চয়তা বা বিপদজনিত আর্থিক ক্ষতি লাঘব বা পূরণ করে দেয়া অথবা যথারিতি বিমা দাবি পরিশোধের প্রতিশ্রুতি প্রদানের বিনিময়ে বিমা গ্রহীতার কাছ থেকে নির্দিষ্ট হারে বা নির্দিষ্ট সময় পর পর একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অথবা এককালিন অর্থ গ্রহণ করে, তাকেই বিমার কিস্তি বা প্রিমিয়াম বলা হয়।
জীবন বিমার ক্ষেত্রে সাধারণত বার্ষিক কিস্তিতে প্রিমিয়াম সংগৃহীত হয়ে থাকে। তবে বিমা গ্রহীতার সুবিধার্থে ষান্মাসিক, ত্রৈমাসিক এমন কি মাসিক প্রিমিয়াম প্রদানের ব্যবস্থাও রয়েছে।
৫. মোট বিমা অংক বা ঝুঁকির অংক টা কি?
জীবন বিমার বিষয়বস্তু হচ্ছে মানুষের জীবন। জীবনের কোন মূল্য নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তাই জীবন বিমার ক্ষেত্রে বিমা গ্রাহক নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রিমিয়ামের বিনিময়ে কোন বিমাকারী প্রতিষ্ঠান যে আর্থিক সুবিধা প্রদান করে, উক্ত আর্থিক সুবিধার পরিমাণকে মোট বিমা অংক বা Sum Assured বলে।
৬. প্রিমিয়ামের হার কিভাবে নির্ধারণ করা হয়?
বিমা আইন, ২০১০ অনুসারে বিমার প্রিমিয়াম নির্ধারণ করবেন এ্যাকচ্যুয়ারি। যে সমস্ত বিষয়ের উপর নির্ভর করে প্রিমিয়াম নির্ধারণ করা হয় তা হলো বিমা অংক, বিমার মেয়াদ, বিমা গ্রাহকের বয়স, অফিস খরচ, Mortality Table, কমিশন খরচ ইত্যাদি।
৭. বিমা পরিকল্প কি?
বিমা ও বিমা গ্রাহকের মধ্যে বিমা কোম্পানি নির্দিষ্ট প্রিমিয়ামের বিনিময়ে কি কি ঝুঁকি গ্রহণ করবে অর্থ্যাৎ বিমা গ্রাহককে কি কি সুবিধা প্রদান করবে, কি কি সুবিধা প্রদান করবে না, কি কি বিষয়গুলো ঝুঁকির মধ্যে থাকবে না, বিভিন্ন শর্তাবলি ইত্যাদি উল্লেখপূর্বক এ্যাকচ্যুয়ারি কর্তৃক যে স্কিম তৈরি করা হয়, উক্ত স্কিম কে বিমা পরিকল্প বলে। উদাহরণ মেয়াদী পরিকল্প, সাময়িক পরিকল্প ।
৮. বিমা চুক্তি কি?
মানুষের জীবন অথবা সম্পদের সম্ভাব্য ঝুঁকি স্থানান্তরের নিমিত্ত বিমাগ্রহিতা ও বিমাকারির মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদিত হয় তাকে বিমা চুক্তি বলে। বিমা চুক্তির ক্ষেত্রে বিমাগ্রহিতা নিদিষ্ট মেয়াদে কিস্তি বা প্রিমিয়াম পরিশোধের বিনিময়ে ঝুঁকি স্থানান্তর করে এবং বিমাকারী প্রিমিয়াম গ্রহণের মাধ্যমে নিদিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে। অর্থাৎ কোন সম্ভাব্য দূর্ঘটনার ফলে যদি বিমাগ্রহিতার সম্পদের ক্ষতি হয় হয়, অথবা জীবনের মৃত্যু অথবা জীবন বিমার মেয়াদ শেষে বিমাগ্রহিতাকে অথবা তাঁর মনোনীতককে বিমাকারী কর্তৃক নির্ধারিত পরিমান অর্থ পরিশোধ করার চুক্তিই হলো বিমা চুক্তি।
৯. বিমা প্রস্তাব কি?
বিমা গ্রহণের নিমিত্ত বিমাগ্রহিতা লিখিতভাবে বিমাকারীর নিকট যে আবেদন করে তাই বিমা প্রস্তাব। সাধারণত বিমাকারি প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত ছাপানো কাগজে বিমা প্রস্তাব করা হয়। যেখানে বিমাগ্রহিতার নাম,পিতার নাম, মাতার নাম, পেশার বিস্তারিত বিবরণ, জন্ম তারিখ, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা, বিমার তালিকা ও মেয়াদ, বিমা অংক, প্রিমিয়ামের পরিমাণ, প্রিমিয়াম পরিশোধ পদ্ধতি, আয় ও আয়ের উৎস মনোনীতকের নাম, বয়স, সর্ম্পক, গ্রাহকের স্বাক্ষর, আবেদনের তারিখ, স্বাক্ষীর স্বাক্ষ্য ইত্যাদি লিপিবদ্ধ থাকে।
১০. বিমা চুক্তি করতে হলে বিমাগ্রাককে কি কি তথ্য ও কাগজপত্র দিতে হয়?
বিমা চুক্তি করতে হলে বিমা গ্রাহককে যে সব তথ্য ও কাগজপত্র দিতে হয় তা হলো
১. বিমা গ্রাহকের নাম ও ঠিকানার বিস্তারিত বিবরণ দাখিল করতে হয়।
২. বিমা গ্রাহকের পেশার বিস্তারিত বিবরণ ক্ষেত্র
৩. বিশেষ গ্রাহকের পেশার প্রমাণ দাখিল করতে হয়।
৪. বিমা গ্রাহকের আয়ের বিস্তারিত বিবরণ ক্ষেত্র বিশেষ আয়ের প্রমাণ দাখিল করতে হয়।
৫. বিমা গ্রাহকের পেশাগত ঠিকানা দাখিল করতে হয়।
৬. বিমা গ্রাহকে বয়সের প্রমাণ দখিল করতে হয়।
৭. বিমা গ্রাহক ও মনোনিতকের পাসর্পোট সাইজের ছবি দাখিল করতে হয়।
৮. সুস্বাস্থ্যের প্রমাণ হিসাবে মেডিকেল বা নন মেডিকেল রির্পোট দাখিল করতে হয়।
৯. বড় অংকের বিমা বা বয়স অনুসারে মূত্র পরীক্ষার রিপোর্ট, ECG রিপোর্ট, এক্স রে রিপোর্ট ও রক্ত পরীক্ষার ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট দাখিল করতে হয়।
১০. বিদেশে কর্মরত ব্যক্তিদের পাসপোর্টের সত্যায়িত ফটোকপি এবং সর্বশেষ বাংলাদেশ আগমনের সিলযুক্ত পাসর্পোট পৃষ্ঠা দাখিল করতে হয়।
১১. বিমা গ্রাহককে কি কি বিষয় যাচাই করতে হয়?
বিমা গ্রাহককে সাধারনতঃ নিম্নলিখিত বিষয় গুলো যাচাই করতে হয়
১. প্রস্তাবপত্রের সকল তথ্য সঠিক ও নির্ভুলভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কিনা।
২. বিমা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা বা সামর্থ যথেষ্ট কিনা।
৩. বিমা দলিলে সকল তথ্য সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে কিনা।
৪. বিমা প্রতিষ্ঠানের বিক্রয় প্রতিনিধির যথাযথ নিয়োগ পত্র রয়েছে কিনা।
১২. প্রিমিয়াম কেন বিনিয়োগ করতে হয়?
বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রিমিয়াম আয় থেকে বিমা দাবি, কমিশন, উন্নয়ন কর্মকর্তাদের বেতন বোনাস এবং ব্যবস্থাপনা ব্যয় পরিশোধ করার পর উদ্বৃত্ত অর্থ যদি থাকে নিম্নলিখিত কারণে নিরাপদ ও লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে থাকে
১. বিমা দাবি পরিশোধ
সংগৃহীত প্রিমিয়ামের সাথে সুদ, বোনাস ইত্যাদি যুক্ত হয়ে স্বাভাবিক কারণেই বিমা দাবির পরিমাণ প্রাপ্ত প্রিমিয়ামের তুলনায় অনেক বেশি হয়ে থাকে। তাই প্রাপ্ত প্রিমিয়াম নিরাপদ ও লাভজনক খাতে বিনিয়োগ করে সম্ভাব্য দাবির সমপর্যায়ে আনার জন্য প্রিমিয়াম বিনিয়োগের কোন বিকল্প নেই।
২. আর্থিক ঘাটতি পূরণ
বিমা গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রিমিয়াম পরিশোধযোগ্য বিমা দাবী অপেক্ষা অনেক কম। বিমা দাবির টাকা সময়মত পরিশোধ করতে যেন কোন আর্থিক অসুবিধার সম্মুখীন হতে না হয়, সে জন্য প্রিমিয়াম বিনিয়োগ অপরিহার্য।
৩.জাতীয় অর্থনৈতিক
কর্মকান্ডে সহায়তা দান সরকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড, দেশীয় শিল্পের বিকাশের মাধ্যমে জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদন রপ্তানীর মাধ্যমে জাতীয় অর্থনৈতিক শক্তি সুদৃঢ় করার জন্য বিমা শিল্পের সংগৃহীত বিপুল প্রিমিয়াম বিনিয়োগ করা আবশ্যক।