জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি । আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে মিলিয়ে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়সাধন করা হয় না কেন?

বর্তমান সময়ে জ্বালানি তেলের দাম এক লাফে প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির পর সরকারের পক্ষ হইতে  আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়ানোর কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়েছিলো যে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য হ্রাস পেলে বাংলাদেশেও মূল্য হ্রাস করা হবে।

তবে বিগত কিছুদিন যাবত ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য হ্রাস পেলেও বাংলাদেশে তেলের মূল্য হ্রাস করার কোন পূর্বাভাস দেখা যাচ্ছে না।

সরকার গত ০৬ই অগাস্ট ডিজেল এবং কেরোসিনের মূল্য লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনে ৪৬ টাকা এবং পেট্রলে ৪৪ টাকা বৃদ্ধি করেছে।

জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে

সূচীপত্র

একবারে জ্বালানি তেলের নজিরবিহীন ভাবে এমন বাড়ানোর কারণে জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর প্রভাবে বাজারে যেমন সব জিনিস পত্রের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি করে বেড়েছে পরিবহন ব্যয়ও।

দাম বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ ২০২২

এভাবে মূল্য বৃদ্ধির মন্তব্য করে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলেছিলো যে ২০২১ সালের তেসরা নভেম্বর স্থানীয় পর্যায়ে ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে পুনর্নির্ধারণ (ডিজেল ৮০ টাকা এবং কেরোসিন ৮০ টাকা) করা হয়।

বিশ্ববাজারের মূল্য ওঠানামার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি

সে সময় বিশ্ববাজারে মূল্য বাড়ানোর  প্রবণতা সত্ত্বেও অকটেন এবং পেট্রলের দাম বাড়ানো হয়নি।

এর আগে ২০১৬ সালে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করে পুননির্ধারণ করেছিলো।

অর্থাৎ এর পর দীর্ঘদিন আর বিশ্ববাজারের মূল্য ওঠানামার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি।

চিন্তায় পড়ে বাংলাদেশ সহ বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো

গত জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য  শুধু বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ওই সময়ে বিশ্ববাজারে প্রতি ব্যারেল ২০-২৭ ডলারের জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে পেতে ১২০ ডলার হয়ে গেলে চিন্তায় পড়ে বাংলাদেশ সহ বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশগুলো।

সংকট মোকাবেলা করতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে

কিন্তু মূল্য যখন কম ছিলো, তখন সরকার দেশে তেলের মূল্য হ্রাস না করে লাভ নিয়েছে। কিন্তু এখন যখন আবার তেলের মূল্য হ্রাস পেয়েছে , তখন সংকট মোকাবেলা করতে তেলের মূল্য বৃদ্ধি করে দিয়েছে।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরের শুরুর দিকে কোভিড-১৯-এর প্রকোপ কিছুটা কমে আসার করণে পৃথিবীব্যাপি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যাওয়ায় জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ইউক্রেন এবং রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর পরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম আরও বৃদ্ধি পায়।

ক্রুড অয়েলের দাম এ বছরের জুনে প্রতি ব্যারেল ১১৭ মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছিলো। গত কয়েকদিনে সেটি কমে এসে ৯৫ ডলারের আশেপাশে দাঁড়িয়েছে।

ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে  জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করে

মূলত ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে  জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কিন্তু তখনো দাম সমন্বয় করার পদক্ষেপ নেয়নি সরকার।

এক পর্যায়ে বিশ্ববাজারে পরিশোধিত ডিজেলের প্রতি ব্যারেলের মূল্য ১৭০ ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। তবে বাংলাদেশ মূল্য সমন্বয় করেনি।

কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমছে, তখন এক সঙ্গে বিশাল ব্যবধানে মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে।

বিশ্ববাজারের মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় না করার যুক্তি হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বর্তমান সময়ে জানিয়েছেন , ধাপে ধাপে মূল্য বৃদ্ধি করলে  লিটার প্রতি দশ টাকা করে প্রতি মাসেই বৃদ্ধি করতে  হতো।

মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে  প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না

যদিও গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ডঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন যে মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে  প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না।

  • অভ্যন্তরীণ মার্কেটে দাম সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম। এমনকি এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাত নেই বলে কোন প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আনাই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে।
  •  সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে তেল ক্রয় করে বিশ্ববাজার থেকে।

মূল্য নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে

অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ মার্কেটে সরকার যে মূল্য নির্ধারণ করে দেয়, সে মূল্যেই ভোক্তা ক্রয় করে। আর এই মূল্য নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে, বাজারের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়।

সরকার হয়তো গণমানুষ এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে বিশ্বাবজারের ওঠানামা থেকে ভোক্তাদের বাইরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটা ভোক্তার জন্য সমস্যাও হয়ে দাঁড়ায়,” বলছিলেন মিস্টার মোয়াজ্জেম।

আবার সরকার বিশ্ববাজার থেকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিতে তেল ক্রয় করে। আর সে চুক্তি হয় মূলত কত জাহাজ এবং লিটার তেল ক্রয় করবে  তার ওপর ভিত্তি করে।

ফলে যখন যে চুক্তি হয়, সে চুক্তি অনুযায়ীই তেল পাওয়া যায়- আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য  যাই হোক না কেন।

অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি হলে এখন যে মূল্য আছে, সেই মূল্যে ক্রয় করলে মূল্য  আরও হ্রাস পেলেও চুক্তির দামই দিতে হবে।

“লং টার্মে গেলে তুলনামূলক কম মূল্যে তেল পাওয়া যায়। শর্ট টার্মে ঝুঁকি বেশি। সরকার এলএনজি স্পট মার্কেট থেকে কিনেছিলো। শুরুতে সুবিধা পেয়েছিলো। কিন্তু পরে অনেক বেশি মূল্যে ক্রয় করতে  হয়েছে। আর এখন তো দীর্ঘমেয়াদী চুক্তিই করাই যাচ্ছে না,” বলছিলেন মিস্টার মোয়াজ্জেম।

বিপিসি সাত বছরে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে

আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনামূলক মূল্য  কম থাকার সুবাদে ২০১৪ সালের পর থেকে বিপিসি পরবর্তী সাত বছরে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে।

যদিও ২০১৪ সালের আগে বেশ কয়েক বছর ক্রমাগত ক্ষতির কারণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে।

গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবার প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১১শ কোটি টাকা ক্ষতির কথা জানিয়েছে বিপিসি যদিও সংস্থাটি গত কয়েক বছরের লাভ হতে প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে।

বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের মূল্য বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে

ফলে বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের মূল্য বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে আর ভোক্তাকে এখন নিজের এফডিআর ভেঙ্গে সে তেল ক্রয় করতে হচ্ছে। এ জন্য ভোক্তাকে সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি তেল দিতে মাঝে মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয়টাও দরকার,” বলছিলেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

সূত্র: বিবিসি.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *