প্রতিদিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা যাবে দেশের বন্ধ কূপ হতে
দেশে উৎপাদন স্থগিত হওয়া বিভিন্ন গ্যাসক্ষেত্রের অন্তত:পক্ষে ৩০টি কূপে এখনো ৫০ শতাংশ গ্যাস মজুদ আছে। ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এই গ্যাস উত্তোলন করার সম্ভবনা রয়েছে। এটা করে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুটের ও বেশি গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধিকরা যাবে। পৃথিবীর অনেক দেশই ‘প্রাথমিক রিকভারি’ শেষে ‘সেকেন্ডারি রিকভারি’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্যাস উত্তোলন করে থাকে।
প্রধানমন্ত্রীর উচ্চশিক্ষা গবেষণা তহবিলের অর্থায়নের মাধ্যমে পরিচালনা
বর্তমান সময়ে এক গবেষণায় এ তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ আমিরুল ইসলাম। এই গবেষক নরওয়ের বহুজাতিক তেল এবং গ্যাস কোম্পানি স্টেটঅয়েল (বর্তমানে ইকুইনর) গবেষক হিসেবেও কাজ করতেছেন। উৎপাদন স্থগিত হওয়া গ্যাস ক্ষেত্রগুলোতে গ্যাস আছে কি না-সে গবেষণা কৌশলটি প্রধানমন্ত্রীর উচ্চশিক্ষা গবেষণা তহবিলের অর্থায়নে মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়েছে। ২০১৩ সালে আরম্ভ হওয়া এ গবেষণা শেষ হয় ২০২১ সালে। গবেষণাপত্রটি পুস্তক আকারে তৈরি করে আগামী মাসের শেষ ভাগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জমা দেওয়ার কথা রয়েছে।
জ্বালানি বিভাগের উপর ভর্তুকির চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলছে
দেশে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু উৎপাদন বৃদ্ধি পায়নি। তাই চাহিদা মিটাতে সরকারকে দামী তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করা লাগতেছে। সম্প্রতি দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে যে ব্যয় হয়, এলএনজি আমদানিতে ১২ থেকে ১৫ গুণ বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে জ্বালানি বিভাগের উপর ভর্তুকির চাপ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে চলছে। এলএনজির উচ্চদামের কারণে বর্তমানে স্পট মার্কেট (খোলাবাজার) থেকে এলএনজি আমদানি স্থগিত রেখেছে সরকার।যার করনে গ্যাসসংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় সারা দেশেই লোড শেডিং শুরু হয়েছে। ব্যাহত হচ্ছে শিল্প- কল কারখানার উৎপাদনও।
সংশ্লিষ্ট কূপগুলোতে মজুদ আছে ৫০ শতাংশ গ্যাস
আমিরুল ইসলামের গবেষণায় জানানো হয়েছে, গ্যাস উৎপাদন মূলত কয়েকটি ধাপে করা হয়। প্রাথমিক ধাপে গ্যাসক্ষেত্র (রিজার্ভার) প্রাকৃতিক ভাবেই তার নিজস্ব শক্তির মাধ্যমে গ্যাস ওপরের দিকে ঠেলে দেয়। তিনি আরও জানান ‘আমরা আসলে সেই গ্যাসটাই পেয়েছি, যেটা রিজার্ভার নিজস্ব শক্তিতে আমাদের দিয়েছে। সে হিসাবে আমরা সংশ্লিষ্ট কূপগুলোতে মজুদ থাকা ৫০ শতাংশ গ্যাস পেয়েছি।প্রাকৃতিক ভাবে নিজস্ব শক্তিতে মাধ্যমে গ্যাস ধীরে ধীরে ওপরের দিকে ঠেলে দেওয়ার এ শক্তিটা কমে আসে বলেই আমরা সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস পেয়ে থাকি। আমাদের দেশের অনেক গ্যাসক্ষেত্র থেকে এই ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করেই উৎপাদন কাজ স্থগিত করে থাকি। ’ তিনি বলেন, দ্বিতীয় ধাপে পৃথিবীর অনেক দেশ ‘ডাউনহোল গ্যাস কমপ্রেসার’ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন করছে। এ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য খুব বেশি সক্ষমতার প্রয়োজন হয় না। শুধু মাত্র একটি নির্দিষ্ট ডিভাইস মাটির নিচে বসিয়ে দিলেই হয়ে যায়। এরপর ডিভাইসটি শুধু নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।
হরিপুর তেলক্ষেত্রে রয়েছে ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল
গবেষণায় দেখা যায়, হরিপুর তেলক্ষেত্রে আরো ৩০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ও বেশি। কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রের ৭ নম্বর কূপে ৩,২৬০ মিটার হতে ৩,২৭০ মিটার গভীরে তেলের স্তর রয়েছে; যেখানে ৯০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রয়েছে। যার বাজারমূল্য প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। দেশের পেট্রোবাংলা নির্ধারিত ম্যাপে প্রডাক্ট শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট (পিএসসি) করা ৭, ১০ এবং ১৫ নম্বর ব্লকে পর্যাপ্ত পরিমাণ গ্যাস রয়েছে। বিশেষ করে ভোলায় গ্যাসের পরিমাণ বেশি। এই ব্লকগুলোতে বেশি করে কূপ খননকার্য পরিচালনা করা দরকার। আগামী পাঁচ বছরের ভিতরে এখানে ৩০টি কূপ খনন করা হলে গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে প্রতিদিন এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট, আমাদের গ্যাসের দরকার সে হিসাবে ২৫ শতাংশ গ্যাসের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এই কূপ খননের পাশাপাশি পাইপলাইন ও অবকাঠামো তৈরি করা হলে গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ করা সম্ভব হবে।
বছরে প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের গ্যাস রপ্তানি করছে মিয়ানমার
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের পিএসসি ব্লক এসএস-১১ ও ডিএস-১২ মিয়ানমারের পিএসসি ব্লক এ-৩, এডি-৭ এবং এডি-৮-এর সাথে অবস্থিত। মিয়ানমার এই ব্লকগুলোতে ৯টি কূপ খনন করেছে। এখানে চার ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুদ রয়েছে এবং প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। বছরে প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের গ্যাস রপ্তানি করছে মিয়ানমার। এই দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। তাই যত তারাতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশকে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান করতে হবে। গ্যাসক্ষেত্র থাকতে পারে এমন স্থান খনন করে উৎপাদন আরম্ভ করতে হবে।
প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে বাংলাদেশ
গবেষণায় আরো বলা হয়, দ্বিতীয় ধাপের গ্যাস উত্তোলন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কম্পানি লিমিটেড। এ ছাড়া বাখরাবাদ গ্যাস ফিল্ডের চারটি কূপ স্থগিত রয়েছে। এই কূপগুলো থেকে প্রাথমিকভাবে গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এভাবে বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, মেঘনা, নরসিংদী গ্যাস ফিল্ড, সিলেট, কৈলাসটিলা, রশিদপুর, বিয়ানীবাজার, সালদা, ফেঞ্চুগঞ্জ, শাহবাজপুর, শেমুতাং, সুন্দরপুর, শ্রীকাইল, বেগমগঞ্জ, রূপগঞ্জে যদি দ্বিতীয় ধাপের উত্তোলন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় তাহলে উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে।
গবেষণাটি উচ্চমানের এবং যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য
আমিরুল ইসলামের এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ভূতাত্ত্বিক এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরূল ইমাম। তিনি বলেন, ‘আমিরুল ইসলাম একজন দক্ষ গবেষক, স্থগিত হয়ে যাওয়া কূপগুলো হতে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির বিষয়ে তাঁর গবেষণাটি উচ্চমানের এবং যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য। গবেষণায় তিনি নানা বৈজ্ঞানিক বিশদ ব্যাখ্যা দিয়ে দেশের গ্যাস উত্তোলনের সম্ভাবনা তুলে ধরেছেন।গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের গ্যাসকূপ স্থগিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা কারনে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, গ্যাস উত্তোলন নল ক্ষয় হয়ে যাওয়া, কূপগুলোর পরস্পরের মধ্যে সংযোগসাধন হওয়া ও পানি এবং বালু উৎপাদন বেড়ে যাওয়া
দেশের জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য উচ্চ পর্যায়ে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা দরকার
জ্বালানি খাতের উন্নয়নের নির্দেশনা দিয়ে আমিরুল ইসলাম বলেন, করোনা মোকাবেলার মতো করে দেশের জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়নের জন্য উচ্চ পর্যায়ে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করা দরকার। তাহলেই জ্বালানি খাতের উন্নয়ন শীঘ্রই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।তিনি আরও বলেন, আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের গ্যাস উৎপাদন শেষ, এখন উন্নততর প্রযুক্তি ব্যবহার করে দ্বিতীয় ধাপের গ্যাস উৎপাদন করতে হবে। তাহলেই আমরা গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে পারব।
দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) মাধ্যমে জানা যায়, সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদনে গুরুত্ব দিয়ে বেশ কয়েকটি পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ আরম্ভ করেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের ৪৬টি গ্যাসকূপ ওয়ার্কওভার, অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিদিন ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে সরকার।
বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট
পেট্রোবাংলার তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে জোগান দেওয়া সম্ভব হচ্ছে প্রায় দুই হাজার ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশীয় কূপগুলো থেকে আসছে প্রতিদিন প্রায় দুই হাজার ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সরকার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আমদানি করছে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)।
দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন আশানুরূপ ভাবে বাড়ানো যাবে
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান জানান, সরকার দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা যদি তা করতে পারি তাহলে ভবিষ্যতে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন আশানুরূপ ভাবে বাড়ানো যাবে। এর মাধ্যমে এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরতা কমে আসবে।
সূত্র: কালের কন্ঠ