আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ কবে জয় লাভ করে। আইসিসি ট্রফির ইতিহাস ও কি ভাবে জয় করলো জানা ও অজানা তথ্য
আইসিসি ট্রফিতে কি ভাবে জয় করলো জানা ও অজানা তথ্য । ২৬ বছর আগে আইসিসি ট্রফিতে স্বীকৃতি পাই
আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশা কেমন ছিল
১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। ১৯৯২ সালের আগে আইসিসি ট্রফি থেকে মাত্র ১ টা দেশ বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার সুযোগ পেত। প্রথম প্রথম তখন চ্যাম্পিয়ন হত শ্রীলংকা। দুই বার সেটা হওয়ার পর তারা টেস্ট স্ট্যাটাস পেল। এরপর জিম্বাবুয়ের ঠেলায় অন্যদের আর সুযোগ মিলেনা। ১৯৯২ সালে জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আইসিসি ঠিক করল ১৯৯৬ সালের জন্য সহযোগী দেশগুলা থেকে ৩ টি দেশ নেওয়া হবে। স্বপ্ন দেখার পালা শুরু হল বাংলাদেশের জন্য।
প্রথম পর্বে আইসিসি ট্রফিতে কেমন করে বাংলাদেশ
প্রথম পর্বে আরব আমিরাতের কাছে হারার পরেও স্বপ্ন টিকে থাকল। দ্বিতীয় রাউন্ডে শুরুতে হল্যান্ডের কাছে হারার পরেও একটা আশা ছিল। তবে তার জন্য কেনিয়াকে হারাতেই হবে। প্রথম ২৫ ওভারে ১০০ এরও কম রান তোলা কেনিয়া করল ২৯৫। ১৯৯৪ সালে ৫০ ওভারের খেলায় ২৯৫ ভয়াবহ রান। বাংলাদেশের মানুষ তাও আশায় বুক জিইয়ে রাখল। ওপেনিং জুটি অবিশ্বাস্যভাবে রান তুলছে। জাহাঙ্গীর আর বুলবুল দুজনেই ব্যক্তিগত অর্ধশত পার হয়ে গেছে। রানরেট ঠিক আছে। শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ তুলতে পেরেছিল ২৮২। পরের বছরেই বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশের অনুর্ধ্ব ১৯ দলের কাছে যখন কেনিয়া ঠিক ১৩ রানেই হারে তখনও ক্রিকেট পাগল বাংলাদেশি দর্শকদের জ্বালা মিটেনি। সেই জ্বালা মিটেছিল ১৯৯৭ সালে।
কি ভাবে আমারা আইসিসি ট্রফিতে জিতলাম সেই গল্পই জেনে নেই
সার্ক ক্রিকেট নামে একটা টুর্নামেন্ট আগে ছিল।ভারত পাকিস্তান শ্রীলংকার এ দলগুলোর সাথে বাংলাদেশের জাতীয় দল। নভোজাত সিধু রাহুল দ্রাবিড় আকিব জাভেদের মত নামকরা খেলোয়ার এই টুর্নামেন্টের মাধ্যমে ঢাকায় খেলে যেত। এই টুর্নামেন্টে একবার ফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু আইসিসি ৯৭ এর আগেরবারেরটা বাংলাদেশের জন্য ভাল ছিলনা। তিনটি ম্যাচই তারা হারে। এমনকি ভারতের সাথে ২৩৬ করার পর ভারতের ফাইনালে যেতে যখন সেটা ৩৯ ওভারে করা লাগত সেটাও তারা করে ফেলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তেমন নাম না করা গগন খোড়া বল প্রতি রান তুলে ভারতকে জিতিয়ে দেয়। বাংলাদেশের আশাবাদী দর্শকরা তারপরেও আশা রাখে।
আইসিসি ট্রফিতে কি ভাবে জয় করলো জানা ও অজানা তথ্য
তখন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ পদে অবস্থান করা সাবের হোসেন চৌধুরী মালয়েশিয়াতে। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি হবে মালয়েশিয়াতে। সিনটেথিক টার্ফে খেলা হবে বলে বাংলাদেশের এ ব্যাপারে বিশেষ তথ্য দরকার। এছাড়াও এসিসির মিটিং। সাবের হোসেন গিয়ে দেখেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগের খেলোয়ার গর্ডন গ্রিনিজ মালয়েশিয়াতে। মালয়েশিয়ার জাতীয় দলের কোচ হতে এসেছেন। সাবের হোসেন তখন বহির্বিশ্বে অজানা ক্রিকেট পাগল এক জাতির কথা শুনালেন গ্রিনিজকে। ১৯৯৪ সালের হৃদয়ভঙ্গের কথা বললেন। তখনকার কোচ মহিন্দার অমরনাথ যে কেনিয়া থেকে বাংলাদেশে না ফিরে নিজ দেশেই চলে যান সেটাও বললেন। গর্ডন গ্রিনিজ কি ভাবলেন তা কেউ জানেনি। তবে তার কয়েকদিনের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের কোচ হয়ে গেলেন। নিয়তি হয়ত তাই ছিল।
শত শত মানুষের আশাকে পুঁজি করে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাড়ি দিল মালয়েশিয়ায়। দেশ ত্যাগ করার আগে সমর্থকরা এয়ারপোর্টে আকরাম খানকে বললেন ভাই এবার কিন্তু জিততেই হবে। কুয়ালালামপুর নামার পরেও একই অবস্থা। প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক ছিলেন কয়েকজন। ভাই এবার কিন্তু জিততেই হবে। টুর্নামেন্ট শুরু হওয়ার পর থেকে আয়োজকদের জন্য বিষ্ময়। অন্য দলের খেলায় দর্শক নেই বাংলাদেশের খেলায় অনেক দর্শক। সব প্রবাসী শ্রমিক। ঐ দেশে ছুটি নেওয়া এত সহজ নেয়। তাও সবাই দেশের টানে ছুটে আসে মাঠে।
মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠ। কুয়ালামপুর। প্রথম খেলায় বাংলাদেশ জিতল আর্জেন্টিনার সাথে। এই দেশের এক পত্রিকা তখন মজার শিরোনাম দিল। ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে শুভ সূচনা বাংলাদেশের। সবাই খুশি। একজন বাদে। তিনি কোচ গর্ডন গ্রিনিজ। তিনিই প্রথম প্রথাগত ওপেনিং এর ধারনা বদলে নাইমুর রহমান দুর্জয়কে ওপেনিং য়ে পাঠান। দুর্জয় সাত চার আর দুই ছক্কায় ৩৭ বলে ৫৩ করে রান আউট। বাংলাদেশ ১৩৮ চেজ করতে পাঁচ উইকেট নেই। গ্রিনিজ বললেন দুর্জয়ের উচিত ছিল ৮০ বা ৯০ করে অপরাজিত থাকা। তা না করে ৫৩ করে অযথাই রান আউট। আতাহার আলী অবশ্য ওপেনিংয়ে নেমে ৩৯ রানে অপরাজিত ছিল। পরের খেলায় অবশ্য দুর্জয় অপরাজিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সাথে বাংলাদেশের টার্গেটই ছিল অবশ্য ৮৩। তারপরের খেলায় আবারও গর্ডন গ্রিনিজ খুশি না। ডেনমার্কের ৯৯ চেজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ৫ উইকেট নেই। গ্রিনিজ বললেন ১০০ করার আগেই যদি ৫ উইকেট চলে যায় তাহলে বড় দলগুলোকে হারাবো কি ভাবে পরের খেলা আরব আমিরাতের সাথে। বাংলাদেশের জনগণের নড়ে চড়ে ওঠার দিন। উৎকন্ঠার দিন। ১৯৯৬ সালে যে তিনদল বিশ্বকাপ খেলে তার মধ্যে একটি আরব-আমিরাত। আগের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ যে তিনদলের কাছে হারে তার মধ্যে একটি আরব-আমিরাত। তবে এবার তারা দাড়াতেই পারেনি। বাংলাদেশের ২০৫ এর বদলে তারা করল ৯৫। এমনকি পশ্চিম আফ্রিকা আর ডেনমার্কের ম্যাচের মত আকরাম খান এই ম্যাচেও নিজেই বল করে ২ উইকেট নিল। গ্রুপের শেষ খেলা স্বাগতিক মালয়েশিয়ার সাথে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জেতার কথা। আগের সবগুলা খেলায় ব্যাটিং অর্ডারে খালেদ মাসুদ পাইলট ছিল ১১ নম্বরে। এই খেলাতেও সে ১১ নম্বরে। বাংলাদেশের ইনিংসের শেষ বলটিই খালি খেলার সুযোগ পেল। সেটাতে ৬ মারল। স্ট্রাইকরেট ৬০০। সেই ৬ দেখে গর্ডন গ্রিনিজ তার ডায়েরীতে কিছু একটা টুকে রাখল।
২২ টি দল থেকে টুর্নামেন্ট তখন ৮ দলে চলে এসেছে। বাংলাদেশের গ্রুপের অন্য তিন দল হংকং আয়ারল্যান্ড আর হল্যান্ড। আবারও নড়েচড়ে বসার পালা। ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ খেলা হল্যান্ড। ১৯৯৪ আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ যে ৩ দলের কাছে হারে তার মধ্যে দ্বিতীয় দল হল্যান্ড। এর আগে আরব আমিরাতকে বাংলাদেশ প্রথম রাউন্ডেই বিদায় করে দিয়েছে। বাংলাদেশের গ্রুপ থেকে ডেনমার্ক এসেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। প্রথম খেলা বাংলাদেশের হংকংয়ের সাথে। হংকংয়ের সাথে বাংলাদেশ সবসময়েই কিংকং। হংকং করলই ১৪৫। সেলুনে চুল কাটতে গিয়ে তা শুনলাম। বলা বাহুল্য তখন প্রতিটি খেলা রেডিওতে শুনানো হত। ধারাভাষ্য দিতেন চৌধুরী জাফর উল্লাহ শারাফাত। বাসা বাড়ি দোকান অফিস সব জায়গাতেই বাংলাদেশের খেলার ধারাভাষ্য শুনে সবাই। পুরা দেশের মন মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাব মাঠে। আসতে আসতে বাংলাদেশ মহাকাব্য রচনাতে ব্যস্ত।
সবাই মহাকাব্যের অংশ হতে চায়। মহাকাব্যে ক্লাইমেক্স থাকে। সেই ক্লাইমেক্স আসলো পরের ম্যাচেই। বাংলাদেশের সাথে আয়ারল্যান্ড করল ১২৯। বাংলাদেশ ৬ ওভারে ২৪ করার পর বৃষ্টি শুরু হল। পরবর্তীতে বাংলাদেশের টার্গেট হল ২০ ওভারে ৬৬। আয়ারল্যান্ডের খেলোয়াড়রা কারচুপির সুযোগ নিল। তারা বলল মাঠ অনুপযোগী। মাঠকর্মীদের পাশাপাশি তখন বাংলাদেশের খেলোয়াড়রাও মাঠে। তোয়ালে দিয়ে মাঠ শুকানোর চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ দলের কোচ বিশ্ব ক্রিকেটের মোটামুটি প্রবাদ পুরুষ গর্ডন গ্রিনিজও তোয়ালে নিয়ে মাঠে। খেলা হতেই হবে। খেলা হয়নি। ম্যাচ রেফারীকে গর্ডন গ্রিনিজ বললেন স্যার কাজটা ভাল হলোনা। ইতোমধ্যে আয়ারল্যান্ড হল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ায় তারা সেমিফাইনালে।
হল্যান্ড ৫০ ওভারে করল ১৭১। বাংলাদেশে ৮ ওভারে ১৫ রান ৪ উইকেটে। উত্তেজনা হৃদয় ভঙ্গের আশংকায় কাঁপছে ড্রেসিং রুম কাঁপছে বাংলাদেশ। বৃষ্টি আসলো। কিন্তু রিভাইসড টার্গেটে এবার ঠিকই খেলা হল। মাঠ অনুপযোগী মর্মে বাংলাদেশের আপত্তি ধোপে টিকলনা। ৩৩ ওভারে করতে হবে ১৪১। ড্রেসিং রুমে বাংলাদেশ দলের পেসার সাইফুল ইসলাম বললেন আল্লাহ এই গরীব দেশটাকে দেখল না। খালেদ মাসুদ পাইলট বললেন হে আল্লাহ আমার প্রিয় কাউকে তুলে নাও। তাও আজকে জিতিয়ে দাও।
১২ কোটি মানুষের দোয়ার শক্তি আল্লাহ আকরাম খানের ব্যাটে দিয়ে দিলেন। বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরবর্তী ইতিহাস রচিত হল আকরাম খানের ব্যাটে। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে দশ বছর এগিয়ে দিল ৯২ বলে আকরাম খানের করা ৬৮ রানের একটি ইনিংস। চার ছক্কায় পারদর্শী হলেও আকরাম খান চার মারল মাত্র ৩ টি। কারণ তিনি জানতেন ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য এই ইনিংস না। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের পালাবদলের ইনিংস। দেশের জন্য মৃত্যু সব সময়েই মহান কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশের জন্য মৃত্যুর গুরুত্ব ছিল অন্য রকম। সেই মৃত্যু জাতিকে স্বাধীন দেশ দিয়েছিল। আকরাম খানের ৬৮ রানও যেন সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু। যারা এই ইনিংস সেই সময় বসে রেডিওতে শুনেছে তারা সবাই জানে এটা আসলে কি ছিল। এমনকি তাকে সঙ্গ দেওয়া মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর রান হয়ত ২২ ছিল। কিন্তু ২২ ও মাঝে মাঝে অনেক বড় কিছু। বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠেছিল আর বিজয় রানটিও এসেছিল আকরাম খানের ব্যাট দিয়েই। আরব আমিরাতের পর হল্যান্ডকেও বিদায় করা গেল ।
বাংলাদেশ বনাম হল্যান্ডের খেলা নিয়ে আরেকজন লেখকের স্মৃতিচারণ তুলে ধরলাম। লেখকের ছদ্মনাম বিচ্ছিন্ন আবেগ।
এই খেলা শুরু হওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডের পয়েন্ট ছিল ৫ বাংলাদেশের ৩ আর হল্যান্ডের ১। আয়ারল্যান্ড ততক্ষণে সেমিফাইনালে উঠে গিয়েছিল। তাই বাংলাদেশ আর হল্যান্ডের মাঝে যে জিতবে সে ই যাবে সেমিফাইনালে হল্যান্ড জিতলে দুইদলের পয়েন্ট হবে সমান কিন্তু হেড টু হেডে বাংলাদেশ বাদ পরে যেত। ১৫ রানে ৪ উইকেট পড়ার পরে আকরাম খান আর নান্নু ক্রিজে ছিল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল যেহেতু ম্যাচ পরিত্যক্ত হলে বাংলাদেশের পয়েন্ট হবে ৪ আর হল্যান্ডের ২ তাই বাংলাদেশ সেমিফাইনালে উঠে যেত। তাই আকরাম আর নান্নু নানা ধরনের টালবাহানা করছিল যেমন ওভারের মাঝখানে হেলমেট চাওয়া গ্লাভস বদলানো পানি খাওয়া ইত্যাদি। আকরাম আম্পায়ারকে বলেছিল যে বৃষ্টির কারণে বল দেখতে অসুবিধা হচ্ছে, কিন্তু আম্পায়ার তাও খেলা চালিয়ে যাচ্ছিল। আকরাম আর নান্নু অনেক স্লো খেলে উইকেট ধরে রাখছিল যেন DL মেথডে এগিয়ে থাকা যায় কিন্তু বৃষ্টির কারনে আম্পায়ার ঐদিনের খেলা বন্ধ ঘোষনা করার কিছুক্ষন আগে নান্নু রানআউট হয়ে যায়।
খেলা বন্ধ হওয়ার পর খেলোয়াড় সাংবাদিক দর্শক সবাই ভেবেছিল বৃষ্টির কারনে খেলা পরিত্যক্ত হলে বাংলাদেশ ১ পয়েন্ট পেয়ে সেমিফাইনালে উঠে যাবে কেউ তখনও খেয়াল করেনি যে DL মেথডে খেলার ফল নির্ধারনের জন্যে প্রয়োজনীয় ওভার ততক্ষণে খেলা হয়ে গিয়েছে এবং আর খেলা না হলে DL মেথডে বাংলাদেশ হেরে যাবে। উইকেটে আকরাম খান ছাড়া আর কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ছিল না বলে সবাই রাতভর প্রার্থনা করেছিল যেন পরদিন আর খেলা না হয়। পরদিন সকালে বৃষ্টি দেখে তাই যখন সবাই খুশি তখনই আম্পায়ার দুঃসংবাদটা দেন। আর তাই যারা এতক্ষন বৃষ্টি হওয়ার প্রার্থনা করছিল তারাই তখন বৃষ্টি থামার জন্যে প্রার্থনা শুরু করে দিল শুরু হয় উৎকণ্ঠার প্রতিটি মূহুর্ত। বাংলাদেশের ক্রিকেট ভবিষ্যৎটাই তখন হুমকির মুখে। সবাই তখন ১৯৯৪ সালের দুর্ভাগ্যের কথা মনে করছিল। সেদিন ছিল শুক্রবার মালয়েশিয়ার বাংলাদেশী শ্রমিকরা কাজ ফাঁকি দিয়ে স্টেডিয়ামে এসেছিল আর প্রার্থনা করছিল অবশেষে বৃষ্টি থামল আর বাংলাদেশের নতুন টার্গেট ঠিক হল ৩৩ ওভারে ১৪১। তারপর আকরামের সাথে সাইফুল ইসলামের সেই শ্বাসরুদ্ধকর পার্টনারশীপ এবং বাংলাদেশের জয়। সবাই কেঁদেছিল সেদিন খেলোয়াড় কোচ সাংবাদিক সমর্থক সংগঠক সবাই। এই জয়ের গুরুত্ব বা জয়ের অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা সবচেয়ে ভাল লিখা হয়েছিল ক্রিকইনফোতে Gordon Greenidge crying. Just imagine a win that makes Greenidge cry a man who had come from a different country a different culture. The owner of one of the fiercest square cuts ever seen the man with the double century on one leg, the man whose image first comes to mind when the words beware the wounded batsman are said Greenidge cried after that win. Thats how much it meant to the team. এরপর আর কি ই বা বলার থাকতে পারে
সেমিফাইনালের বিপক্ষ দল স্কটল্যান্ড। খেলা টিভিতে সম্প্রচারিত হবে তবে সেই চ্যানেল তখন বাংলাদেশে নেই। রেডিওটাই ভরসা। বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাটিং। আতাহার আলী খান আউট হওয়ার পর সবাই মোটামুটি অবাক কানে শুনল অবাক নয়নে দেখল বলার উপায় নাই যে ওয়ানডাউন ব্যাটসম্যানের নাম খালেদ মাসুদ পাইলট। এর আগে তার ব্যাটিং পজিশন ছিল ১১। গর্ডন গ্রিনিজের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত কাজে আসল। খালেদ মাসুদ পাইলট করল ৭০ বাংলাদেশ দল ২৪৩ করল। স্কটল্যান্ডের পক্ষে তা টপকানো সম্ভব হয়নি। রফিকের বলে শেষ ব্যাটসম্যানের ক্যাচটি যখন আমিনুল ইসলাম পয়েন্টে ধরল তখন বলটি নিয়ে তিনি সিজদা দিতে গেলেন। তার আগেই অবশ্য পাশের ফিল্ডারের সিজদা দেওয়া শুরু। রেডিও ধারাভাষ্যকার উত্তেজিত। মানুষ উল্লাসে ঘরের বাইরে। বাংলাদেশ বিশ্ব্কাপে। কারো কারো কাছে তখনও ব্যাপারটা স্বপ্ন। কেউ কেউ উল্লাস জমিয়ে রাখল। এখনও একটা বোঝাপড়া বাকি।
আমাদের মিডিয়ার কারণে আমরা তখনও খালি আমাদের খবরই পেতাম কিন্তু আন্তর্জাতিক মতামত হচ্ছে ১৯৯৭ সালের সব থেকে সেরা দল কেনিয়া। স্টিভ টিকলো আর মরিস ওদুম্বের মত খেলোয়াড় অন্য কোন দলে নেই। উদীয়মান থমাস ওদোয়া ভবিষ্যতের তারকা। মার্টিন সুজি ততদিনেই স্টার বোলার। স্টিভ টিকলোর ব্যাপারটা অবশ্য না বুঝে উপায় নেই। ফাইনালে কেনিয়া করল ২৪১ টিকলো একাই ১৪৭। কতটা নির্দয় হলে এই পরিমান রান একাই কেউ করে। কেনিয়ার ব্যাটিংয়ের দিনই বৃষ্টি আসায় একদিন চলে গেল। বৃষ্টির কারণে পরেরদিনও খেলা হবে অর্ধেক। ২৫ ওভারে বাংলাদেশের করতে হবে ১৬৬। ১৬৫ করলে টাই হবে ব্যাপারটা এমন না। ১৬৫ করলে ১ রানে পরাজিত। ডিএল মেথড তখন এমনই অদ্ভুত
মালয়েশিয়ার মত দেশে টানা দুদিন ছুটি নেওয়া কঠিন কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকরা যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে মাঠে এসেছে। বাংলাদেশ দল ওপেনিংয়ে পরিবর্তন এনেছে। তাড়াতাড়ি রান তুলতে হবে তাই আতাহার আলী খানের বদলে মো রফিক। সেই আতাহার আলী খান ঐদিন ছিলেন ১১ নম্বর ব্যাটসম্যান। প্রথম বলেই দুর্জয় আউট। ক্লিন বোল্ড। বোলার মার্টিন সুজি। রফিককে নামানো কাজে আসলো। ১৫ বলে ২৩ করে রানরেট এগিয়ে রাখল। মাঝখানে হাল ধরেছিল আকরাম খান আর বুলবুল। এরপর যত নাটক।
শেষ ১০ ওভারে লাগে ৭৯। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা একটি করে ৬ মারে আর আউট হয়। এভাবে শেষ তিন ওভারে দরকার হয় ৩৩। আসিফ করিমের করা ওভারের প্রথম বলে ছয় মারে সাইফুল ইসলাম আর শেষ বলে খালেদ মাসুদ পাইলট। মাঝখানে সাইফুল ইসলাম আউট। ২ ওভারে যখন ১৯ লাগে তখন প্রথম বলে চার মারেন খালেদ মাহমুদ সুজন পরের বলেই স্টাম্পিং। শেষ ওভারে লাগে ১১ হাতে উইকেট ২ টি। মার্টিন সুজির করা প্রথম বলে ছয় মেরে পুরা দেশকে জাগিয়ে তুলল খালেদ মাসুদ পাইলট। ৫ বলে ৫। পরের বলটা মিস। ৪ বলে ৫। পরের বলটা ওয়াইড। ৪ বলে ৪। পরের বল ব্যাটে লাগিয়েই ক্রিজ বদল। ৩ বলে ৩ ব্যাটসম্যান হাসিবুল হোসেন শান্ত। মারলেন লাগলনা ২ বলে ৩ পরের বল লাগল। পুল শট কাদামাটিতে বাউন্ডারী পার হলনা। ১ বলে ১। তারপরের বল কি হল তা বাংলাদেশের কেউ জানেনা। তারা খালি রেডিওতে শুনল এবং বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন বলটা যে লেগ সাইডে ছিল শান্তর পায়ে লেগে শর্ট ফাইন লেগে গেল পাইলট যে আগের থেকে দৌড়ের স্টেপ নিয়ে রেখেছিল এবং বহু মানুষ এটাই জানতে পারেনি যে এটা লেগবাই। তাতে কারও কিছু যায় আসেনা। মালয়েশিয়াতে আকরাম খান দৌড়াচ্ছেন। তার পিছন পিছন দৌড়াচ্ছেন সাবের হোসেন চৌধুরী। প্রবাসী বাংলাদেশিরা যে যেভাবে পারছেন ছুটছেন। ১২ কোটি বাংলাদেশিও বসে নেই। সবাই আজ বাইরে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পর এমন অদ্ভুত কিছু কেউ কোনদিন দেখেনি। ১৯৭১ সালের চুড়ান্ত বিজয় অনেক মহান। স্বজন হারানোর বেদনা ছিল। তবে ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল কোন স্বজন হারানোর বেদনা নেই। পরের দিনই ছিল বাংলা নতুন বছরের শুরু। তার আগেরদিন জাতির এমন প্রাপ্তিতে খুশি আর কারও ধরেনা। অতি আবেগীরা চোখের জলও ধরে রাখতে পারছেনা। খেলাটি সরাসরি সম্প্রচার করা হয়নি। তবে পরে হাইলাইটস দেখার সময় হার্ষা ভোগলের কথাটা শোনা গিয়েছিল ছিল দিস ইজ এ গ্রেট এচিভমেন্ট ফর এ কান্ট্রি হুইচ ইজ জাস্ট টুয়েন্টি ফাইভ ইয়ার্স ওল্ড। বাংলাদেশের কোচ গর্ডন গ্রিনিজকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হল। একমাত্র বিদেশী ক্রিকেটার যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন। নতুন দিনের সূচনা হবে। নতুন দিনের মিছিল শুরু হবে। সেই মিছিলে আনন্দে গা ভাসাতে আমিও ছিলাম। মানুষের উৎসব আমি দেখেছিলাম। এটা আমারও উৎসব ছিল। প্রতিটি বাংলাদেশিরই ছিল।
তার কয়েকদিন পরেই মাগুরা নামক একটি জায়গায় এক ফুটবলারের বাচ্চা ছেলে তার বাবাকে বলে বাবা আমি ক্রিকেটার হতে চাই। বাবা বলে ফুটবলার না কেন? ছেলে বলে ফুটবল খেলে বিশ্বকাপ খেলতে পারবনা। সেই ছেলে পরে বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলেছে। সেই ছেলে এখন বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার। আমরা আশা রাখি সেই ছেলে একদিন আমাদের জন্য বিশ্বকাপ নিয়ে আসবে। তার নাম সাকিব আল হাসান। অসম্ভব বলে কিছু নেই।