সুস্থ থাকার উপায়

ডেঙ্গু জ্বর হলে করণীয় ২০২২ । ডেঙ্গু ধরা পড়লে ভয়ের কোনো কারণ নেই

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণও করছেন। এ নিয়ে কাটছে না শঙ্কা। কিন্তু  ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে করনীয় কি? বা ডেঙ্গু ঠেকানোর উপায় কী? এ বিষয়ে কথা বলেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অধ্যক্ষ, মে‌ডি‌সিন বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদ।

প্রশ্ন : ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমে যাওয়া নিয়ে অনেকে বেশ উদ্বিগ্ন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সূচীপত্র

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : মানুষের দেহে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মাত্রা হলো দেড় লাখ হতে চার লাখ।রত্তক্ষরণ বন্ধে প্লাটিলেটের ভূমিকা রয়েছে। ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট আক্রান্ত হয় ও বেশির ভাগ রোগীর প্লাটিলেট কাউন্ট হ্রাস পায়।

কখনো কখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে চলে যায় তবে জানতে হবে সেই বিপজ্জনক পর্যায়টা কত।একজন মানুষের পূর্বে হয়তো প্লাটিলেট স্বাভাবিক ছিল। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর এটা কমে হয়তো এক লাখ হলো, পরের দিন ৮০ হাজার হলো। এরপর কমে ৬০ হাজার হাজার হলো। এ রকম হতে পারে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ল্যাবরেটরির কম্পিউটারে এর মাত্রা ১০ হাজার হতে ২০ হাজার বা এদিক-সেদিক হতে পারে। তাই যদি কারো প্লাটিলেট ৫০ হাজারের মধ্যে থাকে, তবে চিন্তা করার কোনো দরকার নেই। প্লাটিলেট ২০ হাজারে নেমে এলেও কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না। তবে ৫০ হাজারের নিচে প্লাটিলেট নেমে গেলে তখন হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে।

প্রশ্ন : ইদানীং দেখা যাচ্ছে, ডেঙ্গু হলে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায়ও রক্তের প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে।

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : যদি দেখা যায়, কেউ রক্তশূন্যতায় ভুগছেন, দ্রুত প্লাটিলেটের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে, চামড়ায় রক্তবিন্দুর পরিমাণ বেশি দেখা যাচ্ছে, মাসিকের সময় অতিরিক্ত রক্ত যাচ্ছে, দাঁতের গোড়া বা মাড়ি দিয়ে রক্ত পড়ছে, খাদ্যনালি হতে রক্ত পড়ছে, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর রক্তদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন নিয়োজিত চিকিৎসকরা। রোগী বা রোগীর লোকজনের উচিত প্লাটিলেটের বিষয়টি না ভেবে চিকিৎসকদের ওপর বিশ্বাস রাখা।

প্রশ্ন : জ্বরের সঙ্গে অনেকের বমিও হচ্ছে। এটা কি খারাপ কোনো লক্ষণ?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : বমি মানুষের একটা প্রটেক্টিভ ম্যাকানিজম। কারো দেহে যখন একটা রোগ প্রবেশ করে, তখন সেখানে কতগুলো নন-স্পেসিফিক সিম্পটম হয়। কারোর বমি, মাথা ব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, চামড়ায় অস্বস্তি হতে পারে, ক্ষুধামান্দ্য হতে পারে—এসবই নন-স্পেসিফিক সিম্পটম। তবে ডেঙ্গু হলে কারো কারো ক্ষেত্রে পেটের অভ্যন্তরে কোনো কোনো অর্গানকে ইফেক্ট করতে পারে, সেটা হেপাটাইটিস হতে পারে, লিভারের এনজাইম বৃদ্ধি পেতে পারে।

প্রশ্ন : এই সময় ভিটামিন ‘সি’ বেশি খাওয়ার কথা বলা হয় কেন?

ডা. আবুল কালাম আজাদ : ভিটামিন ‘সি’ আমরা পছন্দ করি। এটা রক্তনালিকে শক্তিশালী করে। কিছুটা হলেও ক্ষুধামান্দ্য থেকে রক্ষা করে। কিছু কিছু হিলিং এর ক্ষেত্রে ভিটামিন ‘সি’ খাওয়া যেতে পারে। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রোল রয়েছে। অর্থাৎ শরীরে যখন বিক্রিয়া হয় কিংবা সেলগুলো ওলটপালট হয়, তখন ভিটামিন ‘সি’ বেশ উপকার করতে পারে।

প্রশ্ন : ডেঙ্গু এনএস১ পজিটিভ মানে কী?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : এনএস১ হলো একটা অ্যান্টিজেন। নন-স্ট্রাকচারাল অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিজেন ডেঙ্গু ভাইরাসের উপস্থিতিকে প্রমাণ করে। যার জন্য ডেঙ্গু শনাক্ত করতে আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এনএস১ অ্যান্টিজেন রক্ত পরীক্ষাটি করাতে বলি। সংক্রমণের পর সাধারণত এক হতে তিন দিনের মধ্যে এর রিপোর্ট পাওয়া যায়।

প্রশ্ন : ডেঙ্গু রোগ আসলে কতটা ভয়াবহ? রোগী কখন জটিলতার দিকে যেতে পারে?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : রক্ত পরীক্ষায় যদি কারো ডেঙ্গু ধরা পড়ে, এতে ভয়ের কিছু নেই।  চিকিৎসা  সঠিক পরিচর্যা করলে জ্বর ভালো হয়ে যায় এবং ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। তবে কোনো চিকিৎসা না করালে ডেঙ্গু কিন্তু প্রাণঘাতী হতে পারে। ডেঙ্গু থেকে মারাত্মক সমস্যা হলো প্লাজমা লিকেজ, ডিআইসি, মায়োকার্ডিটিস, রক্তপাত, তরল জমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, কোনো অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট ইত্যাদি।

প্রশ্ন : ডেঙ্গু হেমোরেজিক বোঝার উপায় কী?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, জ্বরের সাথে প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম ও রক্তে হেমাটোক্রিট (রক্তের পরিমাণের সাথে লোহিত কণিকার পরিমাণের অনুপাত) ২০ শতাংশ কমবেশি হলে সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। এর সাথে রক্তবমি, প্লাজমা লিকেজ উপসর্গ যেমন প্রোটিন কমা, পেটে বা ফুসফুসে পানি জমার মতো উপসর্গ থাকতে পারে।

প্রশ্ন : দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ কেন?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : ডেঙ্গুর উদ্বেগজনক বিষয়টি হলো, একবার সংক্রমিত হয়ে যাওয়া মানুষকে পুনরায় মারাত্মক সংক্রমণের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি আলাদা সেরোটাইপ থাকে। কেউ একবার একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে তার আরো তিনবার ডেঙ্গু হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়গুলো বেশ বিপজ্জনক হতে পারে। অর্থাৎ একবার কারো ডেন১ হওয়া মানে তার শরীরে কতগুলো অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এখন ডেন২ হওয়া মানে নতুন করে নতুন অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, যা আগের অ্যান্টিবডির সঙ্গে মারাত্মকভাবে রি-অ্যাকশন করতে পারে। এ কারণে তীব্র ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। সে জন্য বলা হয়, দ্বিতীয়বারের মতো ডেঙ্গু হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রশ্ন : এই জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কি আলাদা থাকা দরকার?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : মানুষ থেকে মানুষে  ডেঙ্গু ছড়ায় না। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের মশা এড়িয়ে চলা উচিত। এই জ্বরে আক্রান্ত রোগী যতক্ষণ পর্যন্ত অসুস্থ থাকবে, তার রক্তের মধ্যে ওই ভাইরাস থাকতে পারে। সে সময় একটি জীবাণুবাহী এডিস মশা কামড় দিয়ে রক্ত শুষে অন্য একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তার অবশ্যই ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ জন্য কোনো ব্যক্তি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে কমপক্ষে ৯ দিন পর্যন্ত তাকে মশারি টানিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা করে রাখা উচিত।

প্রশ্ন : ডেঙ্গু ভাইরাস কি চিরকাল মানবদেহের সিস্টেমে থাকে?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ :  ডেঙ্গু ভাইরাস চিরকাল মানবদেহের সিস্টেমে থাকে না, কিন্তু ভাইরাসের জন্য যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সেই অ্যান্টিবডিটা চিরকাল সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়।

প্রশ্ন : এ ধরনের একটা কথা এখন বেশ প্রচলিত যে পেঁপে পাতার রস খেলে নাকি প্লাটিলেট বাড়ে?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : এ তথ্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও নেই। আমরা সব সায়েন্টিফিক পেপার ঘেঁটে দেখেছি, কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধে বা প্লাটিলেট বাড়াতে পেঁপে পাতার রসের কোনো উপকারিতার অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাইনি। স্থানীয়ভাবে অনেক কিছুতে যেমন লতা, গুল্ম, পাতায় ভেষজ দ্রব্য থেকে মানুষ উপকার পাওয়ার চেষ্টা করে। এটাও এমন ধরনের একটা বিষয় হতে পারে।  যেহেতু কথাটা উঠেছে, তাই আমাদের ফার্মাসিস্টদের উচিত সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা আসলেই এর কোনো উপকারী দিক রয়েছে কি না।

প্রশ্ন : এডিস মশা একবার কামড় দিলেই কি ডেঙ্গু হতে পারে?

ডা. খান আবুল কালাম আজাদ : হ্যাঁ, এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশা কারো শরীরে একবার কামড় দিলেই কারো ডেঙ্গু হতে পারে যদি সেই ব্যক্তির ওই টাইপের ডেঙ্গু পূর্বে না হয়ে থাকে। অর্থাৎ কারো ডেঙ্গু সেরোটাইপ১ হয়তো একবার হয়েছিল আগে, তখন মশা কামড় দিলে তার সেরোটাইপ২ হবে। অর্থাৎ এক সেরোটাইপ একবার হলে বাকি জীবনে আর ওই সেরোটাইপের ডেঙ্গু হয় না।

সূত্রঃ News24bd.tv

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *