রমজান এর শেষ দশকে ইফতেকাফের ফজিলত

পবিত্র রমজান মাসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাত । আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিন  তার বান্দাদের জন্য রমজান মাসের সন্মানে খুলে দেন রহমত,মাগফিরাত ও নাজাতের দরজা সমূহ । রমজান মাসে রোজা রাখা ছাড়াও রয়েছে বিশেষ আমল আর সেটি হলো ইতিকাফ ।

ইতিকাফ একটি আরবি শব্দ ।মূলধাতু ‘আকফ’ থেকে গঠিত আর আকফ এর অর্থ স্থির থাকা ,অবস্থান করা । ইসলামের পরিভাষায় ইতিকাফ হচ্ছে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় যে মসজিদে জামাতসহকারে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা হয় এমন   মসজিদে  দুনিয়াবি সকল  কর্ম,পরিবার-পরিজন থেকে নিজেকে বিরত রেখে এবং মসজিদের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করে  রাখাকে বলে ইতিকাফ । 

ইতিকাফ জায়েজ সব সময়। ইতিকাফ সারা বছরই মুসলমানের  সুন্নত এবং রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফ করার ফজিলত অনেক আর সবচেয়ে  উত্তম। কেননা আমাদের প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজান মাসের  শেষ দশদিন সবসময় ইতিকাফ করে গেছেন।

ইতিকাফের সূচনা 

ইতিকাফের সূচনা হয় হজরত ইবরাহিম আ:-এর যুগ থেকে । মহান আল্লাহ তায়ালা হজরত ইবরাহিম আঃ এবং ইসমাঈল আঃ কে ইতিকাফকারীদের জন্য কাবাঘর পবিত্র রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে যে – ‘তোমরা উভয়ে আমার (কাবা) গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতিকাফকারী, রুকু ও সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র রাখো।’ (সূরা বাকারাহ-১২৫) জাহেলি যুগ থেকে ইতিকাফের প্রচলন ছিল এবং বহাল থাকে ইসলাম আগমনের পরও তা । উমর রা: থেকে বর্ণিত হয়েছে- ‘জাহিলি যুগে তার এক রাত ইতিকাফ করার জন্য মান্নত ছিল। তিনি এ সম্পর্কে নবী কারীম সাঃ -কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তাকে ইতিকাফ করার নির্দেশ দেন।’ (সহিহ বুখারি-২০৩২)


ইতিকাফ তিন প্রকার  

প্রথম প্রকার হলো  ওয়াজিব ইতিকাফঃ  যদি  কেউ কোনো কারণবশত ইতিকাফের মান্নত করে তাহলে সেই ব্যক্তির ওপর ঐ মান্নত পূরণার্থে ইতিকাফ করা ওয়াজিব হবে ।

দ্বিতীয় প্রকার মুস্তাহাব ইতিকাফঃ  এক বা দু’দিন নফল ইতিকাফকে বলা হয় মুস্তাহাব ইতিকাফ।

তৃতীয় প্রকার সুন্নাতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া ইতিকাফঃ অর্থাৎ  যে ইতিকাফ রমজানের শেষ দশকে করা হয়।

আলী বিন হোসাইন (রা.) নিজ পিতা থেকে বর্ণীত , রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে  ১০ দিন ইতিকাফ করে, তা দুই হজ ও দুই ওমরাহর সওয়াবের সমান।’ (বায়হাকি)

ইতিকাফের ফজিলত :

শরিয়তে রয়েছে রমজানের শেষ দশকে ইতিকাফের ফজিলত অনেক বেশি । নবী সা:-এর হাদিসে বর্ণিত  রমজানে সিয়াম সাধনার ফজিলতের পাশাপাশি ইতিকাফ বেশ ফজিলত সম্পূর্ণ। হুসাইন ইবনে আলী রা: সূত্রে বর্ণিত- রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাসের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, সে যেন দু’টি হজ ও দু’টি ওমরাহ করেছে।’ (কাশফুল গুম্মাহ, পৃষ্ঠা- ১/২১২)

অন্য  আর এক হাদিসে ইতিকাফকারীর জন্য এসেছে মহা সুসংবাদ,  ইবনে আব্বাস রা: সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল সা: বলেন, ‘ইতিকাফকারী ইতিকাফের কারণে গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় এবং সব নেকির সওয়াব অর্জন করে।’ (আল মুগনি-৩/৪৫৫) সামান্য কয়েক দিন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদে অবস্থান গ্রহণ করলেই তিনি বান্দার জীবনের সব গুনাহ মাফ করবেন আর পূর্ণ করে দেবেন তাদের আমলনামা।

মনকে সাফ ও সহিহ নিয়তে ইতিকাফকারীকে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে দুই দিগন্তেরও বেশি দূরে রাখবেন। হজরত ইবনে আব্বাস রা: বলেন, রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে, আল্লাহ তায়ালা তার এবং জাহান্নামের আগুনের মধ্যে তিনটি পরিখার দূরত্ব সৃষ্টি করবেন। প্রত্যেক পরিখার প্রশস্ততা দুই দিগন্তের চেয়েও বেশি।’ (বায়হাকি)

ইতিকাফ অবস্থায় কী করা যায় আর কি করা যায় না সে সম্পর্কে 

ইতিকাফ এর সময় কোরআন পাঠ, গুরুত্বপূর্ণ সুরা, দোয়া, তাসবিহ মুখস্থ করা, দীর্ঘ সময় ধরে নামাজের অভ্যাস করা, মুসলিম মনীষীদের জীবনচরিত অধ্যয়ন করা , তাসবিহ, দরুদ শরিফ ইত্যাদি পাঠ করে আমল করা যায়। 

গভীর রাতে দীর্ঘ সময় ধরে দোয়া,  তাহাজ্জুদ বা আমলে লিপ্ত থাকা এবং ইফতার, সাহরি ও প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর গভীর দোয়ায় লিপ্ত থাকা একান্ত প্রয়োজন।

পুরুষদের মসজিদে ইতিকাফ করতে হয় এবং  নারীরা নির্দিষ্ট ঘরে বা নির্ধারিত কক্ষে ইতিকাফ করতে হয় ।একান্ত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঐ কক্ষ থেকে বের  হওয়া যাবেনা । অজু বা পাক-পবিত্রতার জন্য বাইরে বের হলে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলা যাবেনা  না এবং  সালাম বিনিময় করা যাবেনা । কেউ সালাম দিলে তার জবাবও দেয়া যাবেনা। তবে  দরকার হলে ওই কক্ষের ভেতর থেকে বাইরের কাউকে ডাকতে পারবেন । ইতিকাফের কক্ষে এমন কেউ অবস্থান করতে পারবেন, যাঁরা ইতিকাফ করছেন না। ইতিকাফ কক্ষটি যদি শয়নকক্ষে হয় এবং একই কক্ষে বা একই বিছানায় হয়, তবে অন্য যে কেউ অবস্থান করেন, তাতেও কোনো ক্ষতি নেই; এমনকি স্বামীও পাশে থাকতে পারবেন; তবে দাম্পত্য আচরণ ইতিকাফ অবস্থায় নিষিদ্ধ। এতে ইতিকাফ ভেঙে যাবে। ইতিকাফের সময় ইবাদত-বন্দেগিই মুখ্য।

ইতিকাফের শর্তসমূহ

নিয়ত

ইতিকাফকারী আল্লাহর ইবাদত ও সন্তুষ্টি,  নৈকট্য   অর্জনের উদ্দেশে মসজিদে অবস্থানের নিয়ত করবে।

 যে মসজিদে ইতিকাফ করা হবে তা জামে মসজিদ হতে হবে

জামে মসজিদ অর্থ যে মসজিদে জুমার নামাজ পড়া হয় এবং যাতে যেকোনো এলাকার মুসাল্লীদের নামাজ আদায়ের অধিকার উন্মুক্ত থাকে।

বড় অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন

অতএব জুনুবী ব্যক্তি, হায়েয ও নিফাসগ্রস্ত নারীর ক্ষেত্রে ইতিকাফ করা শুদ্ধ নয়,  কেননা এদের মসজিদে অবস্থান করা বৈধ নয়।

ইতিকাফকারীর জন্য যা বৈধ

১) একান্ত বিশেষ  প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া, যেমন খাওয়া ও পান করার প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া যদি তা মসজিদে হাজির করার মত কেউ না থাকে। পেশাব পায়খানার প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে।

২)  চুল ভাঁজ করা বা আঁচড়ানো বৈধ ।

৩) মানুষের সাথে প্রয়োজনে উপকারী কথাবার্তা বলা। কিন্তু অতিমাত্রায় কথাবার্তা বলা উচিত হবে না। কেননা তা ইতিকাফের উদ্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক হবে।

৪) আত্মীয়স্বজন পরিবার পরিজন  ইতিকাফকারীর সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য আসতে পারবে। 

ইতিকাফ বাতিলকারী-বিষয়সমূহ

১) প্রয়োজন ছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে মসজিদ থেকে বের হওয়া, যদিও তা অল্প সময়ের জন্যও হয়; আয়েশা রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানবিক প্রয়োজন ব্যতীত মসজিদ থেকে বের হতেন না।’

২) স্বামী-স্ত্রীর মিলন, যদিও তা রাতের বেলা হয়।

৩) ইতিকাফ ভঙ্গ করার দৃঢ় ইচ্ছা ব্যক্ত করা।

যদি কোনো মুসলিম সুনির্দিষ্ট দিনের ইতিকাফের নিয়ত করে, এরপর ইতিকাফ ভঙ্গ করে ফেলে তবে তার জন্য ইতিকাফ কাযা করা বৈধ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *