কোরবানি কি? কোরবানির পশুর গোশত কয় ভাগে ভাগ করার নিয়ম এবং কিছু মাসআলা

কোরবানির পশুর গোশত ভাগ করার নিয়ম ও মাসআলা

সূচীপত্র

 

 

আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কোরবানি করা পশুর মাংস ভাগ করার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। মহানবী (সা.) কোরবানির পশুর মাংস ভাগ করার নিয়ম সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) কোরবানির মাংস একভাগ নিজের পরিবারকে খাওয়াতেন, একভাগ গরীব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং একভাগ দিতেন গরীব-মিসকিনদের।

 

কোরবানির জন্য সূরাতে বলা হয়েছে,ফাছাল্লিল রাব্বিকা ওয়ানাহার। আরো অনেক সূরাতে বলা হয়েছে 

 

১. কোরবানি কি বা কেন করা হয়?

কোরবানি হচ্ছে পরিশুদ্ধ আত্মাকে পরিপূর্ণ ভাবে আয়ত্ব করা। জীব আত্মার কুস্বভাব কেটে ফেলার নাম হচ্ছে কোরবানি ‌। কোরবানি এক ধরনের আত্মত্যাগ সর্বভাবে নিজেকে আত্মসমর্পণ করার নাম হচ্ছে কোরবানি ‌। পশুর গলায় ছুরি না দিয়ে নিজের ভিতরের পশুকে ছুরি মারতে অভ্যস্ত হও তবেই কোরবানির সঠিক ভাবে আদায় হবে। ‌তা ছাড়া কোরবানি কারো উপরেই ফরজ নয়। জীব হত্যা মহাপাপ ও বটে কোরআনেতে পাই , এটা বুঝলে আরো ভালো ভাবে কুরবানীর হক বুঝতে সহজ হবে। কুরবানী ওয়াজিব তদ্রুপ ভিতরের ছয়টি কু’ রিপুকে বিতাড়িত করে পশু কোরবানি নিয়ত করা সুন্নত বা ওয়াজিব কাজ ‌। প্রকৃত কোরবানি হচ্ছে নিজের নফসকে আল্লাহ নামে কুরবানী করা।

 

২. কতটুকু সম্পদের মালিক হলে কুরবানী ওয়াজিব হয় ?

কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার জন্য সচ্ছল ও সামর্থবানের পরিমাণ হল, যাকাতের নেছাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া। তবে যাকাতের জন্য নেছাব সমপরিমাণ সম্পদের এক বৎসর অতিবাহিত হতে হবে। কিন্তু কুরবানীর জন্য ঐ সম্পদের এক বৎসর অতিবাহিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং ১০ই জিলহজ্ব ফজর হতে ১২ই জিলহজ্ব সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যাকাতের নেছার সমপরিমাণ সম্পদের মালিক হলে তার উপর ঐ সময়ের মধ্যে যে কোন দিন কুরবানী করা ওয়াজিব।

 

৩. ঋণী ব্যক্তি কুরবানী করবে নাকি তার ঋণ পরিশোধ করবে?

ঋণী ব্যক্তি কুরবানী না করে ঋণ পরিশোধ করাই তার কর্তব্য। ঋণী ব্যক্তির কুরবানী করার অর্থ ফরয নামাজ না পড়ে নফল নামায পড়ার ন্যায়, যার কোন প্রয়োজন নেই।

 

৪. কুরবানী করার সুন্নত নিয়ম কি ?

কুরবানী করার সুন্নত পদ্ধতি হলো, যার উপর কুরবানী ওয়াজিব সে নিজের পক্ষ থেকে এবং পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে নিজ হাতে কুরবানী করবে। কুরবানীর পশু একটি হোক কিংবা একাধিক হোক অথবা ভাগে করলে একভাগ হোক কিংবা একাধিক ভাগ হোক। একটি পশু বা একভাগ কুরবানী নিজের ও নিজের পরিবারবর্গের জন্য যথেষ্ট।

 

৫. সচ্ছল মুসাফিরের উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে কি?

কুরবানী ওয়াজিব হল স্থায়ী অধিবাসীর উপর। মুসাফিরের উপর নয়। যদিও মুসাফির সচ্ছল বা সামর্থবান হয়। তবে কোন মুসাফির যদি সফর থেকে বারোই যিলহজ্ব সূর্যাস্তের পূর্বেই বাড়িতে পৌঁছে তাহলে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।

 

৬. যে ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব সে যদি বিশেষ কোন কারণে কুরবানী করতে না পারে, তাহলে সে কি করবে ?

কুরবানী ওয়াজিব হলে, বিশেষ কোন কারণে কুরবানী করতে না পারলে , এই অবস্থায় যদি সে পূর্বেই কুরবানীর উদ্দেশ্যে কোন পশু খরিদ করে থাকে, তাহলে সেই পশু জীবিত অবস্থায় কাউকে দান করে দেবে। আর কোন পশু খরিদ না করে থাকলে তার কুরবানীর বিনিময়ে একটি ছাগলের মূল্য দান করে দেবে।

 

৭. মৃত ব্যক্তির নামে কুরবানী করা যাবে কি?

মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কুরবানী করা যায়। অবশ্য মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে সদকা করাই উত্তম। এমনিভাবে রাসূল (সঃ) এর পক্ষথেকেও কুরবানী করা যায়।

 

৮. কয় প্রকারের প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা বৈধ, জানাবেন।

ছয় প্রকারের প্রাণী দ্বারা কুরবানী করা যায়। যথা- উট, মহিষ, গরু, দুম্বা, ছাগল ও ভেড়া। এগুলো ছাড়া অন্য পশু দিয়ে কুরবানী করা জায়েয হবে না।

 

৯. কুরবানীর পশুর বয়স

দুম্বা, ছাগল, ও ভেড়া কুরবানীর জন্য পূর্ণ এক বৎসর বয়সের হতে হবে। তবে এসব পশু এক বৎসর বয়সের আদৌ পাওয়া না গেলে, তাহলে দেখতে এক বৎসর বয়সের মত লাগে এমন ছয় মাসের পশু দিয়েও কুরবানী করা যাবে। গরু ও মহিষ পূর্ণ দু’বছর বয়সের হতে হবে। আর উট হতে হবে পাঁচ বছর বয়সের । তার কম বয়সের হলে কোনটির কুরবানী জায়েয হবে না।

 

১০. গোশত তিন ভাগ করা কি জরুরি?

যার যার ভাগের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করে এক ভাগ নিজের জন্য, এক ভাগ আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীর জন্য কোরবানি করেছেন এমন আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদেরও দেয়া যাবে, আরেক ভাগ গরিব-দুখী মানুষের জন্য। এরূপ বণ্টন করা মুস্তাহাব। কিন্তু এরূপ তিন ভাগ করা জরুরি কিংবা আবশ্যক নয়। এতে হেরফের বা কমবেশি করলে কোনো অসুবিধা নেই। আপনি চাইলে গরিবকে একটু বাড়িয়ে দিলেন কিংবা প্রতিবেশীর জন্য একটু বেশি রাখলেন কিংবা আপনি নিজের জন্য একটু বেশি রাখলেন, এতে কোরবানির কোনো ক্ষতি হবে না। তবে আবশ্যক নয় বলে পুরোটা নিজে খাওয়া মানবিকতার দিক থেকে অনুচিত।

 

১১. কোরবানির গোশত কত দিন ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে?

কোরবানির গোশত যত দিন ইচ্ছা ফ্রিজে রেখে খাওয়া যাবে। এটি একান্তই প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাপার। এ ব্যাপারে শরিয়ত কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি।

 

১২. কুরবানির নেসাব

কুরবানির নেসাব হলো-স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ৭.৫, ভরি। রুপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন , ৫২.৫ ভরি। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে হিসাব হলো-এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা/ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা-রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজনের অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা/ভরি রুপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলে তার ওপর কুরবানি করা ওয়াজিব।

 

১৩. কোরবানির গোশত মোটামুটি তিনটি ভাগে ভাগ

করার একটি নির্দেশনা বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তাহলো

১. কোরবানি দাতা নিজেদের জন্য রাখবে

২. আত্মীয়-স্বজনদের এক ভাগ দেওয়া

৩. যারা অভাবি বা গরিব।

 

কুরবানির মাসআলা

 

 

১. ছাগল তথা খাসী কুরবানী করা উত্তম।

মিশকাত- ১৪৬১ সুবুলুস সালাম- ৪/ ১৮৫।

 

২. চার ধরণের পশু কুরবানী করা নাজায়েজ।

ক. স্পষ্ট খোঁড়া।

খ. স্পষ্ট কানা।

গ. স্পষ্ট রোগী,জীর্ণ শরীর।

ঘ. অর্ধেক কান কাটা কিংবা ছিদ্র এবং অর্ধেক শিং ভাংগা।

মিশকাত- ১৪৬৫।

 

৩. কুরবানি কাদের উপর ফরয?

কুরবানি দেওয়া ফরয নয়, সুন্নতে মুয়াক্কাদা। যার সামর্থ্য আছে পশু কেনার, তিনি কুরবানী দেওয়ার চেষ্টা করবেন, এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও ফযীলতপূর্ণ একটা সুন্নত।

 

. ৬ পরিবারের সদস্যদের মাঝে যদি ৬ জনই আয় করে, এবং কুরবানি করার সামর্থ্য রাখে তাহলে কি তাদের সবাইকেই কুরবানি দিতে হবে? নাকি একজন দিলে একজনের পক্ষ থেকেই সবার জন্য কবুল হবে?

ছয়জন আলাদা হলে আলাদা কুরবানি দিতে হবে, আর সবাই একসাথে হলে পরিবারের গার্জিয়ান একা কুরবানি দিলেই হবে।

 

৫. ঋণ থাকলে কি কুরবানি হয়?

হ্যা হয়, ঋণদাতা যদি সময় দেয় তাহলে সে কুরবানি দিতে কোন সমস্যা নাই।

 

৬. বড় বড় ব্যাবসায়িরা বড় বড় ঋণ নেয়। যার সময় থাকে ৫ বছর থেকে ১০ বছর কিংবা আরও বেশী। তারা বড় বড় কুরবানিই দেয়। কুরবানি কি এভাবে হয়?

হবে, যদি হালাল টাকায় কেনা হয় আর ইখলাস ঠিক থাকে। লোক দেখানো হলে বা হারাম উপার্জনের টাকায় কেনা হলে কুরবানি বাতিল।

 

৭. নাবালেগের কুরবানীর হুকুম কি?

নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যার আকল ঠিক নাই , নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা মুস্তাহাব হিসাবে সহীহ হবে।-بدائع ৪/১৯৬, رد المحتار ৬/৩১৬

 

৮. গরীব মিসকিনের কুরবানীর হুকুম কী?

গরিব মিসকিন ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয় কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়لان اوجب على نفسه ।  بدائع  ৪/১৯২

 

৯. কুরবানী করতে না পারার হুকুম কী?

কেউ যদি কুরবানীর দিনগুলোতে ওয়াজিব কুরবানী দিতে না পারে তাহলে কুরবানীর পশু ক্রয় না করে থাকলে তার উপর কুরবানীর উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করে ছিল, কিন্তু কোনো কারণে কুরবানী দেওয়া  না হয় তাহলে ঐ পশু জীবিত সদকা করে দিবে।-بدائع ৪/২০৪,  قاضيخان ৩/৩৪৫

১০. কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে?

উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া , দুম্বা তথা মেষ  জাতীয় চতুস্পদ হালাল গৃহপালিত পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বনগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েয নয়। قاضيخان ৩/৩৪৮, بدائع ৪/২০৫

 

১১. কুরবানীর পশুর বয়সসীমা কত হতে হবে?

উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছর হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা (মেষ)কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে  এক বছরের মতো মনে হয়, তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েয হবে না।قاضيخان ৩/৩৪৮, بدائع ৪/২০৫-২০৬

 

১২. এক প্রাণীতে কতজন শরীক  হতে পারে?

একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারোটাই সহীহ হবে না।

আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারো কুরবানী সহীহ হবে না। – صحيح مسلم ১৩১৮, مؤطا الامام مالك ১/৩১৯, قاضيخان ৩/৩৪৯, بدائع ৪/২০৭-২০৮

 

১৩. সাত শরীকের কুরবানীর মাসআলা কি?

সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না। – بدائع ৪/২০৭

উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েয। -مسلم ১৩১৮, بدائع  ৪/২০৭

 

১৪. কোন কোন পশু কোরবানি করা জায়েয না

১. হাটতে পারেনা এমন পশু

২.রোগা ও দুর্বল পশু

৩.দাঁতবিহীন পশু

৪.শিংবিহীন পশু

৫.অন্ধ পশু

৬.কান বা লেজ কাটা পশু

৭.গর্ভবতী (গাভিন)পশু

 

যিনি কুরবানি দেবেন, কেবল তিনিই যিলহজ মাসের চাঁদ উঠার পর হতে কুরবানির পশু জবাই করা পর্যন্ত নিজের চুল, গোঁফ, নখ কিছুই কাটবেন না।

মিশকাত- ১৪৫৯। যদি ভুলে কেটে ফেলেন তাহলে এর জন্য তোওবা এবং ইস্তেগফার করতে হবে, কোন কাফফারা দিতে হবেনা। পরিবারের অন্য সবাই কাটতে পারবে। পরিবারের সবাইকে চুল, নখ কাটা হতে বিরত থাকতে হবে এমন ধারণা ভুল।

কোরবানী একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিময় আমল। আল্লাহ বলেন فصل لربك وانحر হে নবী আপনি আপনার রবের উদ্দেশ্যে নামাজ পড়ুন আর নহর কোরবানী করুন।

কুরবানী একটি গুরুত্বপূর্ণ মালী ইবাদত। এটি আদায় করা واجب ( ওয়াজিব)।

 

উপরের মাসআলা মান ও জানা সবার জরুরী

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *