ইসলামিক কথা

রমজানে রোজা রাখার ফজিলত

ইসলামের মোট পাঁচটি স্তম্ভের একটি হলো রমজান মাসের রোজা । রমজান নিঃসন্দেহে অন্যান্য মাস অপেক্ষা অধিক মর্যাদাপূর্ণ আমাদের সবার জন্য রহমত, মাগফেরাত আর নাজাতের বার্তা নিয়ে আসে । রোজা একটি ফারসি শব্দ যার  আরবি অর্থ হচ্ছে সওম, বহুবচনে সিয়াম। সওম বা সিয়ামের বাংলা অর্থ হচ্ছে বিরত থাকা। আর সওম বা  সিয়াম সাধনার অর্থ হচ্ছে  সুবহেসাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল ধরনের পানাহার, পাপাচার এবং খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত ও সংযত রাখা।

সূরা বাকারা এর ১৮৫ নং আয়াত দ্বারা দ্বিতীয় হিজরিতে রমজনের রোজা উম্মাতের উপর  ফরজ করা হয়েছে । যদি কেউ রমজানের রোজাকে অস্বীকার করে তবে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে । 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে, ‘আদম সন্তানের প্রতিটি কাজই তার দশগুণ থেকে সাতশত গুণ বৃদ্ধি করা হয়। মহান আল্লাহ তাআলা বলেন যে, কিন্তু রোজা ছাড়া কেননা তা কেবল  আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো। সে আমার সন্তুষ্টির জন্য কামাচার ও পানাহার  ও খারাপ কাজ থেকে নিজেকে বিরত রাখে তবে  রোজা পালনকারীর জন্য রয়েছে দুটি খুশীর সংবাদ। এক যখন সে ইফতার করে, অতঃপর সে খুশী হয় এবং দুই  যখন সে তাঁর রবের সাথে সাক্ষাৎ করবে, অতঃপর তখন রোজার বিনিময়ে আনন্দিত হবে। রোজা পালনকারীর মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর তাআলার কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।’ (‘বুখারি ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১’)

আরো পড়ুন- রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস

‘প্রত্যেক আমলেরই জন্য রয়েছে কাফফারা । রোজা কেবল মাত্র আমার জন্য, তাই আমি এর প্রতিদান দেবো।’ (‘বুখারি ৭৫৩৮, মুসনাদে আহমাদ ১০৫৫৪’ )

রোজাকে অন্যান্য হাদিসের বর্ণনায় আমলের বর্ধিত সওয়াব থেকে আলাদা করা হয়েছে।কেননা অন্যান্য আমলের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশত গুণ করার কথা বলাহয়েছে কিন্তু রোজার ব্যাপারটি আলাদা। কেননা  রোজার সওয়াব সীমাবদ্ধ নয়; বরং আল্লাহ তাআলা নিজে রোজার সওয়াব বহু গুণে দান করবেন। কেননা রোজা এসেছে সবর তথা ধৈর্য থেকে মহান  আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

“কেবল ধৈর্যশীলদেরকেই তাদের প্রতিদান পূর্ণরূপে দেওয়া হবে এবং কোনো হিসাব ছাড়াই।” (সুরা যুমার: আয়াত ১০)

ধৈর্য মোট তিন ধরনের। রোজার মধ্যে একত্রিত হয় এ তিন ধরণের ধৈর্য ।

 ১) আল্লাহর আনুগত্যের ওপর সব সময় ধৈর্যধারণ করা

২) আল্লাহর হারাম জিনিস থেকে নিজেকে বিরত রাখতেধৈর্যধারণ করা 

৩) আল্লাহর ফয়সালাকৃত কষ্টের উপর  সদা  ধৈর্যধারণ করা।

 এ জন্য রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

“ রমযান মাস হচ্ছে ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্যের প্রতিদান হবে জান্নাত।”  (“ইবন খুযাইমা ১৮৮৭”) 

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, আমাদের রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

‘ রোজা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীলতায় লিপ্ত না হয় এবং ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাঁকে (রোজাদার ব্যক্তি) গালি দেয় অথবা তাঁর সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ করে, তাহলে সে যেন বলে, আমি একজন রোজা পালনকারী।’ (বুখারি ১৯০৪,, মুসলিম ১১৫১)

হজরত আবু উবাইদাহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করছেন –

“ রোজা ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভেঙ্গে না ফেলা হয় “(নাসাঈ ২২৩৫, মুসনাদে আহমাদ ১৬৯০)

হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-

‘তিন ব্যক্তির দোয়া কখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। রোজা পালনকারী ব্যক্তি যতক্ষণ না ইফতার করে।’ (তিরমিজি ৩৪৯৮)

যদি রোজা পালনকারী ব্যক্তি রাতে নামাজ আদায় করে এবং দিনের বেলায় রোজা পালনের উদ্দেশ্যে শরীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য পানাহার করে তাহলে সেটি তার জন্য সাওয়াব হিসেবে ধর্তব্য হবে যেমনিভাবে সে রাতে এবং  দিনে কাজের জন্য শক্তি বৃদ্ধি করতে ঘুমালে তা তার জন্য ইবাদত হবে।

হজরত আবু আলিয়াহ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, যদি রোজা পালনকারী গিবত না করা পর্যন্ত ইবাদতে থাকে, সে যদিও বিছানায় ঘুমায়। সুতরাং, রোজাদার ব্যক্তি রাত-দিন সব সময়ই ইবাদতে থাকে এবং রোজা অবস্থায় এবং ইফতারির সময় তার দোয়া কবুল করা হয়। সে দিনের বেলায় রোজা বা সওম পালনকারী ও ধৈর্যশীল এবং রাতের বেলায় আহার গ্রহণকারী ও মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী। ইমাম তিরমিজি ও অন্যান্যরা বর্ণনা থেকে এসেছে –

“ মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায়কারী, আহারকারীর মর্যাদা হলো ধৈর্যশীল রোজা পালনকারীর ব্যক্তির মতো।”  (তিরমিজি ২৪৮৬)

যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং জান্নাত পাওয়ার আশায় পানাহার ও কামভাব ত্যাগ করেছে । যারা উত্তম কাজ করেন তাদের প্রতিদান পাবার আশায় অতপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের প্রতিদান   নষ্ট করেন না। যারা আল্লাহর উপর ভরসা করবে তারা বিফল হবে না, বরং তারা বিরাট লাভবান হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে-

‘আল্লাহর তাকওয়ার উদ্দেশ্যে যা কিছুই তুমি পরিহার বা ত্যাগ করো, তিনি তার চেয়েও উত্তম প্রতিদান দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ ২০৭৩৯)

রোজা পালনকারীদেরকে  জান্নাতে তাদের ইচ্ছামত খাদ্য, পানীয় ও নারী দান করা হবে। মহান আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

“ (রোজা পালনকারীদেরকে বলা হবে ) বিগত দিনসমূহে তোমরা যা আগে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তোমরা তৃপ্তি সহকারে খাও ও পান করো।” (সুরা হাক্কাহ: আয়াত ২৪) 

হজরত মুজাহিদ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে , এ আয়াতটি রোজা পালনকারীদের ব্যাপারে নাজিল করা হয়েছে।

হজরত ইয়াকুব ইবন ইউসুফ রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে, আমার কাছে এ মর্মে সংবাদ পৌঁছায়াছে  যে, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তার অলিদের (বন্ধুদের) বলবেন যে , হে আমার বন্ধুগণ! আমি যখনই তোমাদের দিকে তাকাতাম তখনই দেখতাম তোমাদের ঠোঁট খাদ্যাভাবে শুষ্ক ,দেখতাম তোমাদের চোখ বিনিদ্র, পেট ক্ষুধায় কাঁপত, অতঃপর আজকের দিনে তোমরা তোমাদের নেয়ামতে থাকো, তোমরা পরস্পরে পেয়ালা ভরা শরাব পান করো, তোমরা তোমাদের জন্য যা আগে প্রেরণ করেছ তার বিনিময়ে তৃপ্তি সহকারে খাও এবং পান করো।

হজরত হাসান রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে , হুর (নারী) মধুর নদীতে তার সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা আল্লাহর বন্ধুদেরকে বলবেন, তুমি পান পেয়ালার পানীয় গ্রহণ করো। আল্লাহ তাআলা তোমার প্রতি কঠিন গরমের দিনে তাকাতেন, তুমি তখন প্রচণ্ড তৃষ্ণা থাকা সত্ত্বেও পিপাসিত ছিলে। তখন তোমাকে নিয়ে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের সঙ্গে গর্ববোধ করতেন। তিনি বলতেন, হে ফেরেশতাগণ! তোমরা দেখো আমার বান্দাকে, সে তার স্ত্রী, কামভাব, খাদ্য ও পানীয় আমার সন্তুষ্টির জন্য আমার কাছে যা কিছু আছে তার সবকিছুর বিনিময়ে ত্যাগ করেছে। তোমরা সাক্ষ্য (ফেরেশতাগণ) থাকো, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। 

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে-

“জান্নাতে রয়েছে রাইয়্যান নামক একটি দরজা । যে দরজা দিয়ে কেয়ামতের দিন শুধুমাত্র রোজা পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তারা ব্যতীত আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে যে, রোজা পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। অতপর তাঁরা ছাড়া আর কেউ এ দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাঁদের প্রবেশের পরই সেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এ দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করতে পারে।”  (বুখারি ১৮৯৬)

রমজান মাসে রোজা পালনকারীদের বিয়ে দেওয়া হয় জান্নাতে । আর জান্নাতের হুরদের মহর হলো দীর্ঘ সময় ধরে তাহাজ্জুদের নামাজ। এবং  এ নামাজ রমজান মাসে অধিক হারে আদায় করা হয়।

কিছু রোজা পালনকারী ব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকেই রোজা পালন তথা বিরত থাকে। তারা তাদের মস্তিষ্ক এবং  এর চিন্তাধারাকে হেফাজত করে, পেট এবং পেটে থাকা যা কিছু ধরে সবকিছু সংরক্ষণ করে, মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী পরীক্ষাকে স্মরণ করে, এবং তারা আখেরাত কামনা করে এবং দুনিয়ার সমস্ত চাকচিক্যকে  বর্জন করে। এ ধরণের ব্যক্তিদের ঈদুল ফিতর হবে তাদের রবের সাথে সাক্ষাতের দিন। তাঁকে দেখা হবে তাদের জন্য আনন্দ-উল্লাস।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন যে –

“রোজা পালনকারী ব্যক্তির  মুখের (না খাওয়াজনিত) ঘ্রাণ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়েও উত্তম।” (বুখারি ১৯০৪, সহীহ মুসলিম ১১৫১)

হজরত মাকহূল রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন যে, জান্নাতিগণ জান্নাতে সুঘ্রাণ পাবে এবং তখন তারা বলবেন, হে আমাদের রব! জান্নাতে প্রবেশের পর থেকে এত সুন্দর সুঘ্রাণ আর কখনও পাইনি। তখন তাদেরকে বলা হবে যে – এ হলো রোজা পালনকারীদের মুখের সুঘ্রাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *