রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস

রোজার ইতিহাস পৃথিবী শুরু থেকেই ।   হজরত আদম (আ.) এর মাধ্যমে  শুরু করে মহানবী (স.)-এর আগের নবী হজরত ঈসা (আ.)পর্যন্ত রোজার বিধান হয়ে এখনও চলমান। তবে জানা যায়, বিভিন্ন বর্ণনামতে রোজার সংখ্যা ও নিয়ম পদ্ধতি হুবহু আমাদের মতো ছিল না। কারো কারো জন্য রোজার সংখ্যা ছিল ৩০টি, আবার কারো জন্য ৪০টি  । আবার কোনো কোনো উম্মতের ক্ষেত্রে ছিল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। কারো সঙ্গে কথা না বলাও ছিল রোজার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কোরআনে মরিয়ম (আ.)-এর মত অনুসারে বলা হয়েছে, ‘মানুষের মধ্যে  যদি তুমি কাউকে দেখ তখন বলবে, আমি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে রোজার মানত করেছি (মৌনতা অবলম্বনের মাধ্যমে) । সুতরাং , আজ আমি কিছুতেই কোনো মানুষের সঙ্গে বাক্যালাপ করব না।’ (সুরা মরিয়ম: ২৬)

তাফসিরের বর্ণনায় আছে যে, আদম (আঃ)-এর সৃষ্টির পর আল্লাহ্‌ তাঁকে ‘নিষিদ্ধ ফল’ না খাওয়ার যে আদেশ দিয়েছিলেন- এটাই মানব ইতিহাসের প্রথম সিয়াম সাধনা। আর  আদম (আঃ) সেই রোজা ভাঙার কাফ্ফারাস্বরূপ ৪০ বছর রোজা রেখেছিলেন। এবং  ওই নিষিদ্ধ ফলের প্রভাব আদম (আঃ) এর পেটে ৩০ দিন বিদ্যমান ছিল । যার ফলে আল্লাহর রাসুলের উম্মতদের আল্লাহ এক মাস রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। হজরত ইব্রাহিম (আঃ) থেকে শুরু এবং হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) পর্যন্ত সব যুগে ৩০টি রোজা রাখা ফরজ ছিল। হজরত মুসা (আঃ) রোজা রেখেছিলেন  ৩০ দিন। এরপর তুর পাহাড়ে  তিনি যাওয়ার পর আল্লাহ তাঁকে অতিরিক্ত ১০টি রোজা রাখার আদেশ দেন। যার জন্য তাঁর রোজা হয়েছিল মোট ৪০ দিন।এবং হজরত ঈসাও (আঃ) ৪০ দিন রোজা রাখতেন মুসা (আঃ) এর মতো ।হজরত ইদ্রিস (আঃ) রোজা রেখেছিলেন সারা বছর । দাউদ (আঃ) রোজা রাখতেন এক দিন পর পর অর্থাৎ বছরে ছয় মাস  হজরত ।

আরব সমাজে ইসলাম আসার আগে রোজার প্রচলন ছিল। সেই রোজা আমাদের প্রিয় নবীজিও রাখতেন। মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘জাহেলিও যুগে কুরাইশরা আশুরার রোজা পালন করত এবং আল্লাহর রাসুল (স.)-ও সেই  রোজা পালন করতেন। যখন তিনি মদিনায় আগমন করেন তখনও সেই রোজা পালন করেন এবং তা পালনের নির্দেশ দেন। কিন্তু যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন থেকে আশুরার রোজা ছেড়ে দেওয়া হলো। এরপর বলা হলো যে, যার ইচ্ছা সে রোজা পালন করবে আর যার ইচ্ছা পালন করবে না।’ (সহিহ বুখারি: ২০০২)

 আশুরার রোজাই হিজরত পরবর্তী সময়ে মুসলমানের জন্য ওয়াজিব ছিল। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নবী (স.) যখন মদিনায় আসলেন  তখন দেখতে পেলেন যে ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা রাখে।এবং যখন রোজা রাখার  জিজ্ঞাসা  করা হলো তারা বলল, এই দিনেই আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) ও বনি ইসরাইলকে বিজয় দিয়েছিলেন ফেরাউনের ওপর । সুতরাং আমরা ওই দিনের সম্মানে রোজা পালন করি। রাসুলুল্লাহ (স.) বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা বেশি নিকটবর্তী মুসা (আ.)- এর । এরপরেই তিনি  নির্দেশ দিলেন সাওম পালনের ।’ (সহিহ বুখারি: ৩৯৪৩)

বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, মুসলিমরা প্রত্যেক মাসে তিন দিন রোজা পালন করত। তবে রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে আশুরার রোজা ওয়াজিব ছিল বলে জানা যায় বেশির ভাগ ফকিহ ও মুহাদ্দিসের মতে,এবং যা পরবর্তী সময়ে নফলে পরিণত হয়। এছাড়াও আইয়ামে বিজ বা প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখার বিধান সবসময় মোস্তাহাব ছিল। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, ‘আমার বন্ধু (স.) আমাকে তিনটি কাজের জন্য অসিয়ত করেছেন। যা মৃত্যু পর্যন্ত আমি তা ত্যাগ করব না। এবং সেটি  হলো প্রতি মাসে তিন দিন রোজা রাখা, চাশতের নামাজ আদায় করা এবং বিতর আদায় করে শোয়া।’ (সহিহ বুখারি: ১১৭৮)

যখন  রমজানের রোজা প্রথম ফরজ হয়, তখন থেকে মুমিনদের রোজা রাখা ও ফিদিয়া দেওয়ার ইচ্ছাধিকার দেওয়া হয়। অর্থাৎ এভাবে বলা যায় ,যে চাইবে রোজা রাখবে এবং যে চাইবে রোজার পরিবর্তে মিসকিনকে খাদ্য দান করবে।  আর এ বিধান সুস্থ-অসুস্থ, সবল-দুর্বল সবার জন্যই  । আরও ইরশাদ হয়েছে, ‘(তোমাদের ওপর ফরজ করা হয়েছে) রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের জন্য। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পীড়িত হয় বা সফরে থাকলে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে পারবে । এটা যাদের জন্য  সাতিশয় কষ্ট দেয় তাদের কর্তব্য এর পরিবর্তে ফিদিয়া অর্থাৎ একজন অভাবগ্রস্তকে খাদ্য দান করা।আর  যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকাজ করে  এবং তবে তা তার পক্ষে অধিক কল্যাণকর। আর রোজা বা সিয়াম পালন করাই তোমাদের জন্য অধিকতর কল্যাণকর যদি তোমরা জানতে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৪)

রমজানের  রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরিতে । ইমাম নববি (রহ.) থেকে বর্ণিত যে , ‘রাসুলুল্লাহ (স.) মোট ৯ বছর রমজানের রোজা রেখেছিলেন । কেননা সেটি দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে ফরজ হয়। এবং আমাদের নবী (স.) একাদশ হিজরির রবিউল আউয়ালে ইন্তেকাল করেছিলেন।’ (আল-মাজমুআ: ৬/২৫০)

এরপর রমজানের রোজা ফরজ হয় কোনো অবকাশ ছাড়াই । পবিত্র কোরআনে এ প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে, ‘রমজান মাস। এতে মানুষের দিশারী এবং সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারীরূপে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্য থেকে যারা যারা  এই মাস পাবে তারা যেন এই মাসে রোজা পালন করে। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ পীড়িত হয় বা সফরে থাকে অন্য সময় এই সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে।’ (সুরা বাকারা: ১৮৫)

এরপর অবকাশ ছাড়া রোজা ফরজ হওয়ার সময়ে  রোজার সময়সীমাও পরিবর্তন হয়ে যায়। তাফসিরে ইবনে কাসিরে উল্লেখ করা হয়েছে যে,যখন  রমজানের রোজা ফরজ হয়, তখন রাতের বেলা ঘুমের আগ পর্যন্ত পানাহার এবং স্ত্রী-সম্ভোগের অনুমতি ছিল। এশার নামাজের পর  বা ঘুমের পর পানাহার ও স্ত্রী-সম্ভোগ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন  সময় সংক্ষিপ্ত করে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজার সময় নির্ধারণ করেন।

এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করা হয়েছে যে, ‘ তোমাদের জন্য স্ত্রী-সম্ভোগ বৈধ করা হয়েছে রোজার রাতে। তারা তোমাদের পরিচ্ছদ ও তোমরা তাদের পরিচ্ছদ। আল্লাহ তাআলা জানেন যে তোমরা নিজেদের প্রতি অবিচার করছিলে। অতঃপর আল্লাহ্‌ তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হয়েছেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করেছেন। সুতরাং এখন তোমরা তাদের সঙ্গে সংগত হও ও আল্লাহ যা তোমাদের জন্য বিধিবদ্ধ করেছেন তা পালন করো। আর তোমরা পানাহার করো সে পর্যন্ত যতক্ষণ রাতের কৃষ্ণরেখা থেকে ঊষার শুভ্র রেখা স্পষ্টরূপে তোমাদের কাছে প্রতিভাত না হয়।’ (সুরা বাকারা: ১৮৭)

আর এই হলো চূড়ান্তভাবে  উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রোজা ফরজ হওয়ার ইতিহাস । এর কোনো বিধি আর কেয়ামত পর্যন্ত আর পরিবর্তন বা পরিমার্জন হবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মুসলিম উম্মাহকে সুন্নাহ নির্দেশিত পন্থায় রমজানের রোজা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *